পুনর্জন্মেও আ.চিক ভাষায় কথা বলতে এবং ফিরে আসতে চায় আ.চিক হয়ে। এখন আমার শরীরে আর শক্তি নেই। অসুস্থ শরীর আর অচলপ্রায় পা নিয়ে দিন কাটাচ্ছি। কিন্তু আমার স্ত্রী আমাকে সবসময়ই আগলে রাখেন। আমরা দুজনই এখন বয়সের ভারে ক্লান্ত, তবুও কিন্তু ভালোবাসা তিল পরিমাণ কমেনি।
’মানুষের ইচ্ছার শেষ নেই ! আমি কি হতে চেয়েছিলাম, ঠিক মনে পারছি না। আমার একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। আমাদের গান গাওয়াতেন, নাচাতেন বিভিন্ন কালচারাল এক্টিভিটি করাতেন। সেই সময় থেকেই কালচারাল এক্টিভিটিকেই কেন যেন অন্যান্য কাজের চাইতে আপন মনে হয়েছে। এরপর গানের জগতে নিজের অজান্তেই প্রবেশ করে ফেললাম। গান লিখলাম, সুর করলাম গাইলাম। এভাবেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম, হয়তো এই কাজের জন্যই আমাকে সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন’। কথাগুলো বলছিলেন গারো আদিবাসীদের মধ্যে অন্যতম একজন গুণী শিল্পী ফরিদ জাম্বিল। তাঁর আসল নাম ফরিদ পাথাং। ফরিদ জাম্বিলের গ্রাম নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা থানার তারা নগরে। তাঁর পৈত্রিক ভিটা বর্তমান গ্রামের প্রতিবেশী গ্রাম মনতলায়। তাঁর জন্ম, বেড়ে উঠা, শৈশব সবকিছুই ভারত সীমান্ত ঘেঁষা গ্রাম মন তলায়।
জীবনে তিনি বহু গারো গান লিখেছেন এবং সুর করেছেন। কিছু গান নিজেও লিখেছেন সুর করেছেন আবার কিছু গান অন্য কেউ লিখেছেন আর সেখানে নিজের সুরের ঠিকানা সেধেছেন। গুণী এই শিল্পি বয়সের ভারে ন্যুব্জ এখন। শারীরিক অবস্থা ভাল নেই; তবুও তিনি এখনও গানে সুর করেন গুন গুন করে নিজে গান করেন। আর নতুন প্রজন্মের গান শুনেন। তিনি সবচেয়ে বেশি গর্ব বোধ করেন এই নতুন প্রজম্মের জন্য। এই বর্তমান প্রজম্মরাও নিজস্ব মাতৃভাষা গারো বা আ.চিক ভাষায় এখনো কথা বলা শিখছে, গান গাইছে সুর করছে তা দেখে তিনি উচ্ছসিত হন।
শিল্পী ফরিদ জাম্বিল ও সহধর্মিনী সোহনা নকরেক
গুণী এই শিল্পীর ঝুলিতে রয়েছে অনেক সম্মাননা সংবর্ধনা। বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের অকুন্ঠ ভালোবাসা। কিন্তু ইদানিংকালে তিনি এনিমিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ায় প্রায়শই চিকিৎসাধীন থাকেন। বার্ধক্যজনিত শারীরিক অসুস্থতা যেন বাসা বেধে ফেলেছে তাঁর শরীরে। তিনি বলছিলেন, সৃষ্টিকর্তা সবাইকে বিভিন্ন গুণ দিয়ে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। সবারই ভেতর কোন না কোন গুণ রয়েছে। যা আমাদের মধ্যে লুকায়িত অবস্থায় থাকে। কিন্তু কি জিনিস আমাদের মধ্যে লুকায়িত রয়েছে সেটি বের করা আমাদেরই দায়িত্ব। তিনি বলেন, আমি ফরিদ জাম্বিল যদিও গান লিখেছি, গান সুর করেছি; কিন্তু ততটুকু হয়ে উঠেনি যা হয়তো আমার করার কথা ছিল। তিনি প্রসঙ্গক্রমে আবেগ তাড়িত হয়ে বলেন, আমি যদি আবার জন্মা তাহলে আবারও গারো হয়ে, এই বাংলায়, এই আমার আ.চিক জনগোষ্ঠীর মাঝে জন্মাতে চাই। কথা বলতে চাই নিজের গারো মাতৃভাষায়, আবারও গান গাইতে চায় আমার গারো মাতৃ ভাষায়।
গুণী শিল্পীর জন্ম ১৯৫১ সালে। বয়স এখন ৭১ বছর। তিনি যখন অনেক ছোট ছিলেন তখনই মারা যান তাঁর বাবা। ওঁনার মা বেঁচে ছিলেন যতদিন তিনি সরকারী চাকুরী করতেন। আজ বয়সের ভারে স্মৃতি শক্তি লোপ পেয়েছে। অনেক কিছুই আগের মতোন আর আগলে এবং সামলে স্মৃতিচারণ করতে পারেন না। তবুও নিজের বিশেষ কিছু কাজ, গান, ঘটনা মনে রেখেছেন তিনি। কথায় কথায় তাঁর সাথে যখন দিন পার করছি তখন বলছিলেন গারোদের প্রয়াত সাবেক সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট প্রমোদ মানকিন এমপির কথা। তিনি বলেন, তাঁর জীবন চলার পথে এই এতটুকু আসার পেছনে প্রয়াত এই এমপির অনুপ্রেরণা রয়েছে। তিনি ফরিদ জাম্বিলকে গারোদের মধ্যে তিনি একজন সুর সাগর আখ্যা দিয়েছিলেন এবং গানের পাখি বলে অভিহিত করেছিলেন।
গুণী শিল্পী ফরিদ জাম্বিলের সহধর্মিনী সোহনা নকরেক কে দেখিয়ে তিনি বলেন “এখন আমার শরীরে আর শক্তি নেই। অসুস্থ শরীর আর অচলপ্রায় পা নিয়ে দিন কাটাচ্ছি। কিন্তু আমার স্ত্রী আমাকে সবসময়ই আগলে রাখেন। আমরা দুজনই এখন বয়সের ভারে ক্লান্ত, তবুও কিন্তু ভালোবাসা তিল পরিমাণ কমেনি”। আমাদের অনুরোধে হাসি হাসি মুখ নিয়ে স্ত্রীর দিকে চেয়ে নিজের গানের দুই লাইন গেয়ে শুনান এই সহজ সরল গুণী মানুষ। শরীরে ক্লান্ত এসেছে। বয়স বেড়েছে ; কিন্তু মননে আর হৃদয়ে এখনো যৌবনের ঢেউ খেলে যায় সে ব্যাপারটি হয়তো বুঝা যেত না এই শিল্পির কাছাকাছি না গেলে।
শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার ফরিদ জাম্বিলের গোটা পরিবার
ফরিদ জাম্বিলের গ্রাম মূলত তারা নগর হলেও একে এলাকাবাসীরা বলেন শিবপুর তারনগর। নেত্রকোনা জেলার আরেকটি থানা দুর্গাপুর থানা শহর থেকে বর্ডারের রাস্তা ধরে এগুলে সামনে পরবে লেঙ্গুরা। লেঙ্গুরা যাওয়ার পথে দিন ভাল থাকলে হয়তো দর্শন হয়ে যেতে পারে গারোদের স্বর্গ কথিত চিকমাং আ.ব্রির। বিকেলের লাল আলোয় লেঙ্গুরার রাস্তার উত্তরে এই পাহাড় নিজেকে মেলে ধরে থাকে সবার জন্য। লেঙ্গুরা বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গনেশ্বরি নদীর তীর ধরে দক্ষিণে গেলেই দেখা মিলবে গারোদের এই অসামান্য মানুষ শিল্পী ফরিদ জাম্বিলের গ্রাম শিবপুর তারা নগর। গারোহাব মিডিয়া টিমের হয়ে তার বাসায় যাওয়ার ঠিক আগ মুহুর্ত শিল্পি নিজেই আমাদের ফোন করে দিক নির্দেশনা দিলেন। অত্যন্ত অমায়িক এই মানুষের দাম্ভিকতা নেই। নেই তাঁর কোন অহংকার। মুখে লেগেই থাকে হাসি আর হাসি। তাঁর এই হাসির স্রোত আরও অনেক দূরে বয়ে যাক ভিজিয়ে দিয়ে ধুয়ে দিক আমাদের গারো সংস্কৃতির সকল ধুলা।
শিল্পী ফরিদ জাম্বিলকে নিয়ে নির্মিত তথ্য চিত্রটি দেখতে পারেন গারোহাব অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে। গারোহাব পরিবারের নির্মিত এই তথ্যচিত্রটি প্রযোজনা ও পরিচালনা করেছেন ফ্রান্স প্রবাসী কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব লুই সাংমা। সহ-পরিচালনা, সম্পাদনা ও সিনেমাটোগ্রাফি করেছেন বাপন নেংমিঞ্জা। তথ্যচিত্র উপস্থাপনা করেছেন ফারুক ডি. সাংমা ।
উল্লেখ্য যে, অত্যন্ত মেধাবী ও গুণী শিল্পীর এই শর্ট ডকুমেন্টারিতে শিল্পীর জীবনের সকল তথ্য তুলে আনা সম্ভব নয়; তবুও অল্প সময়ে, স্বল্প পরিসরে চেষ্টা করা হয়েছে শিল্পীর জীবনগাঁথা ও গারোদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাঁর অবদানগুলো অকপটে তুলে ধরা। এ প্রসঙ্গে আ.বিমা টাইমসের সম্পাদক লুই সাংমা বলেন, গারো সংস্কৃতিতে তাঁর অবদান কোনদিন ভোলার নয়। এটি গারোহাব মিডিয়া পরিবারের ক্ষুদ্র চেষ্টায় ডিজিটাল ডাইরীতে আজীবন বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস ছিল মাত্র। যার মাধ্যমে এই গুণী ব্যক্তি সম্পর্কে আপনার জানার আকাঙ্খা কিঞ্চিত হলেও মিটবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
ফিচার লেখক ও ছবি: বাপন নেংমিঞ্জা, শেরপুর