পথ বন্ধ হওয়া মানেই যে সব শেষ হওয়া নয়। এর মানে নতুন পথের শুরু। সেই পথটাকে সন্ধান করতে হয় মাত্র। একটি বাক্য শেষ হওয়া মানেই যে আরেকটি নতুন বাক্যের শুরু!

মাসোহারা কর্মী। বনে গেলেন এবার তিনিই উদ্যোক্তা। আসলে পথ বন্ধ হওয়া মানেই যে সব শেষ হওয়া নয়। এর মানে নতুন পথের শুরু। সেই পথটাকে সন্ধান করতে হয় মাত্র। একটি বাক্য শেষ হওয়া মানেই যে আরেকটি নতুন বাক্যের শুরু! এ কথাগুলো যার ক্ষেত্রে খাটে তিনি ফ্রান্সিলা নকরেক। তার বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার বেদুরিয়া গ্রামে। ফ্রান্সিলা নকরেক একজন উদ্যোক্তা। এর আগে তিনি ছিলেন তাঁত বস্ত্র বয়ন শিল্পী কর্মী।

২০১৯ খ্রিস্টাব্দ থেকেই পীরগাছা ধর্মপল্লীর পাল পুরোহিত তাঁত বন্ধ করার জন্য তাগিদ দিয়ে আসছিলেন। এর মধ্যে ৪০০ সেটের একটা অর্ডার পেলেন ফ্রান্সিলা। এভাবে ২০২০ পর্যন্ত টেনে আনলেন। জানুয়ারির শেষ দিকে ‘মিচিকনি জুমাং’ বন্ধ হয়ে গেল। এর পরই তার নতুন যাত্রা শুরু হয়। হতাশ না হয়ে তিনি স্থানীয় একটি ক্রেডিট ইউনিয়ন থেকে ঋণের জন্য আবেদন করেন। তার নিজের সঞ্চয় এবং ঋণের টাকা দিয়ে ওই বছরের মার্চ মাসে তিনি উপজেলার পীরগাছা গ্রামে গড়ে তুলেন ‘নকরেকনি জুমাং তাঁত শিল্প’। খাদের কিনার থেকে ফিরে আসা সেই ফ্রান্সিলা বর্তমানে তার গড়ে তোলা তাঁত শিল্পে  ৯ জন কর্মী কাজ করছেন।

ফ্রান্সিলা উদ্যোক্তা হিসেবে নবীন হলেও উৎপাদন ও বিপননে মোটেও নতুন নয়। এক্ষেত্রে তার রয়েছে ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা। গেল শুক্রবার পীরগাছায় গড়ে তোলা তার কারখানায় বসেই বাস্তব গল্পের গল্প আ.বিমা টাইমসের সঙ্গে কথা হয়। সে গল্পের আড্ডায় সরল মনে উঠে আসে দারিদ্র সীমার নীচে বাস করা ফ্রান্সিলার স্বপ্ন পূরণের অদম্য বাসনা।

ফ্রান্সিলা নকরেকের তাঁত বস্ত্র বয়ন শিল্প, ছবি: ওয়েলসন নকরেক

অষ্টম শ্রেণীর পর দারিদ্র্যের কারণে আর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় নি ফ্রান্সিলা নকরেকের। ঐ অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় একদিন  ‘আইডিআস’ নামে এক সংস্থার অধীনে তাঁত বস্ত্র বুননের ওপর প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ এলো। আইডিআস এর পরিচালক ছিলেন কারিতাস ময়মনসিংহ অঞ্চলের সাবেক আঞ্চলিক পরিচালক ও কারিতাস বাংলাদেশের সাবেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা আলবার্ট মানখিন। কিন্তু পরিচালক জানালেন, যারা পড়াশোনা করে তাদেরকে নেওয়া যাবে না। এই খবর বাড়িতে এসে মাকে বললেন। কিন্তু তিনি অসন্তুষ্ট হলেন। ফ্রান্সিলাকে ভৎসনা করলেন। কেন ফ্রান্সিলা পড়াশোনা করার কথা বললেন। পরেরবার ফ্রান্সিলা আর এই ‘ভুল’করলেন না। ১৯৯০ সালে একই সুযোগ আবার আসলো। তিনি সুযোগটা লুফে নিলেন। প্রশিক্ষণ নিতে চলে গেলেন ময়মনসিংহের কাঁচিঝুলিতে। সংস্থার খরচে থাকা-খাওয়া আর তেল-সাবান। কোনো ভাতা নাই। কথা ছিল প্রশিক্ষণ হবে ৬ মাসের। কিন্তু চিকন সুতার কাজ শিখতে চেয়ে তার সময় লাগলো ৯ মাস।

প্রশিক্ষণ শেষে পার্শ্ববর্তী সাধুপাড়া গ্রামে একই সংস্থার দ্বারা পরিচালিত তাঁতের কারখানায় ১৯৯১ সালে প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন। বেতন সাকুল্যে ৯৫০ টাকা। সবাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর উৎপাদন শুরু। সেই সময়ে তারা এক্সপোর্টেবল বিছানার চাদর বুনতেন। একটা চাদর দুইজনে মিলে বুনতেন। প্রতিটি চাদরের জন্য একজন পেতেন ৫০ টাকা করে। একদিনে সর্বোচ্চ ২টা চাদর বুনতে পারতেন। কিন্তু কারখানাটি ১৯৯৬ সালে এসে বন্ধ হয়ে গেল। একদিন তিনি পীরগাছা ধর্মপল্লীর তৎকালীন পাল পুরোহিত ফাদার ইউজিন হোমরিক সিএসসি’র সাথে দেখা করতে গেলেন। আর উপহার হিসেবে নিয়ে গেলেন তার বুনা বিছানার চাদর। উপহার পেয়ে খুশি হয়ে তার কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলেন। ফ্রান্সিলা সবিস্তারে বললেন। ফাদার হোমরিক তাকে জানালেন তিনিও তাঁত কারখানা স্থাপন করতে চান এবং তিনি সেই তাঁতে কাজ করার জন্য ফ্রান্সিলাকে প্রস্তাব করলেন। তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করে নাম লিখিয়ে আসলেন।

তাঁত বস্ত্র বয়ন শিল্পীরা, ছবি: ওয়েলসন নকরেক

পরের গল্প ধৈর্য আর একনিষ্ঠতার। ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে ফাদার হোমরিক ‘মিচিকনি জুমাং তাঁত শিল্প’ স্থাপন করলেন। ফ্রান্সিলা মিচিকনি জুমাং-এ যোগ দিলেন। সহকর্মীরা মোটামুটি বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমিই সেই ফ্রাসিলা! তুমি নাকি আমাদের ট্রেইনার হয়বা? কিন্তু, বাস্তবতা ভিন্ন। টাঙ্গাইল থেকে মোস্তফা নামে একজনকে ট্রেইনার হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হলো। যা হোক, আগে থেকে কাজ জানা থাকাই ফ্রান্সিলার নতুন করে প্রশিক্ষণ নিতে হলো না। তিনি সরাসরি উৎপাদনে লেগে গেলেন। ফাদার হোমরিক পীরগাছাতেই থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। কিন্তু এ সুবিধা বেশিদিন ভোগ করতে পারলেন না। পরের বছর থেকেই বাড়ি থেকে যাতায়াত করে ডিউটি করতে হলো। এর মধ্যে বড় মেয়ের বয়স প্রায় এক বছর। মেয়েকে ছোট বোনের কাছে রেখে ডিউটি করতেন। ৫ কিলোমিটার পথ, তার মধ্যে ১ কিলোমিটার আবার বনপথ। সে সময়ে মানুষের যাতায়াতও কম ছিল। রাস্তার দুই পাশে ঘন ঝোপঝাড়। ভয় হতো তাই তিনি স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে যেতেন। ৫ বছর এই কষ্ট করলেন। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে এসে সুদে টাকা ধার নিয়ে একটা সাইকেল কিনলেন। ছোট ছেলের বয়স তখন ৮ মাস। ছেলেকে সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসিয়ে যাতায়াত করতেন। ফ্রান্সিলা নকরেক বলেন, ‘বাবু যেন ঘুমিয়ে না পরে সে জন্য গল্প বলে বলে জাগিয়ে রাখতাম। তবু মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়ত। ছেলেটা একদিন পরেই যাচ্ছিল।’ এই ভাবেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে মেয়েকে মাস্টার্স শেষ করালেন।

আগের কর্মস্থলে দকসারি, গামছা, ওড়না, রুমাল, ফতুয়া তৈরি করতেন। ১০০% সূতির হওয়ার কারণে তাদের বুনা কাপড়ের চাহিদা ছিল। এখনো সেই একই মান বজায় রেখেছেন। সুতা কিনে এনে নিজেরাই তাতে রং দেন। এখন তার উৎপাদিত পণ্যের সুনাম এলাকার গন্ডি পেরিয়ে বাইরেও পৌঁছে গেছে। তার উৎপাদিত পণ্য এলাকার দোকানগুলোতে সরবরাহের পাশাপাশি এখন তিনি ময়মনসিংহেও সরবরাহ করেন। তবে সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় চাহিদা অনুসারে উৎপাদন বাড়াতে পারছেন না বলে জানালেন ফ্রান্সিলা নকরেক।

ভবিষ্যতে তিনি নিজ গ্রামেও তাঁত বসাতে চান। তিনি বলেন, ‘গ্রামের মানুষ যদি কাজ করতে চায় তাহলে ভবিষ্যতে গ্রামেও কারখানা বসাবো।’ তাঁতের কল কেনা, এনে বসানো থেকে শুরু করে নানা কাজে স্বামী সুজনের সহযোগিতার কথা স্বীকার করেন।

আজকাল এসব প্রান্তিক উদ্যোক্তাদের গল্প কেইবা মনে রাখে ! কেইবা  মনে রাখে তাদের অবদান। মনে না রাখুক! তবুও ওঁরা এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে এগিয়ে যাচ্ছে না খেয়ে, না ঘুমিয়ে। দিনের পর দিন স্বপ্ন বুনে যাচ্ছে  ক্ষুদ্র উদোক্তারা। নিষ্ঠা এবং প্রচেষ্টা থাকলে আপনার স্বপ্ন পূরণ হতে কতক্ষণ ! এমন অপ্রতিরোধ্য বাসনা এবং ফ্রান্সিলার স্বপ্নেরা সুখ তারা হয়ে হাজার বছর বেঁচে থাকুক।