আদিবাসী সংগঠনগুলোর দেহ আছে; শুধু নেই যৌবন
পারিবারিক, সামাজিক উন্নয়ন, সমাজ সংস্কারের নামে রাষ্ট্রে, দেশে অগণিত মানব সংগঠনের জন্ম হয়েছে। গ্রাম থেকে নগর পর্যন্ত গারোসহ বহু আদিবাসী সংগঠন সদর্পে আবির্ভাব হয়েছে। নতুন চিন্তা চেতনায় আর্বিভূত হয়েছে। এসব সংগঠনের কার্যক্রম, নতুনভাবে অবিভূর্ত হবার ক্রিয়া প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে, ধাবিত থাকবে নিকট ভবিষ্যতেও। কিন্ত আমাদের কাছে এমন নজিরও হাতে আছে ঘর আলোকিত না করতেই ব্যক্তি স্বার্থের রোষানলে, ক্রোধের দাবদাহে বা জ্বালায় পড়ে অকালে সংগঠনের আলো চিরতরে নিভে গেছে। আবার কোন কোন সংগঠন ভঙ্গুর প্রায় এখন।
ধরুন খোদ মধুপুর আ.বিমায় সে পথ ধরে ট্রাইভাল ওয়েলফার এসোসিয়েশান, জয়েনশাহী উন্নয়ন পরিষদ, আ.চিক মিছিক সোস্যাইটি, আজিয়া, জেএসএফ, বাগাছাস, গাসু আরও অজানা সংগঠনের হয়তো জন্ম। এদের শাখা প্রশাখা তৈরি হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার মারফতে জানতে পারলাম, অতি সম্প্রতি দীর্ঘদিন বিরতির পর টিডাব্লিউর নির্বাচন, আজিয়া নামক সংগঠনের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এভাবে কাউন্সিলের পর কাউন্সিল হবে, সংগঠনের নির্বাচন হবে, গঠনতন্ত্র পরিবর্তন, পরিমার্জন হবে। অগ্রজ অনুজ মিলিয়ে, নতুন নেতৃত্ব আসবে। এটাই সংগঠনের ধর্ম, সাংগঠনিক স্বকীয়তা।
এসব সকল সংগঠনের আস্ত ফিরিস্তি তুলে ধরা আজকের প্রতিপাদ্য বিষয় নয়। তুলে ধরার ইচ্ছেও নেই। গোটা ফিরিস্তি লিখতে গিয়ে তখন এমন হতে পারে কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপ বেড়িয়ে আসবে। অনেক সংগঠনের চোখে দেয়া সুরমা বা কাজল, কপালের টিপ, দেহে পড়নের কাপড় ঠিক নেই; অথবা হতে পারে দেহ, আত্মা আছে কিন্ত যৌবন নেই, হাড্ডিসার চিত্র এমন কঠিন দুরাবস্থাগুলি সুর সুর করে কলমের ডগায় বেড়িয়ে আসবে এটা সুনিশ্চিত।
মানুষের ধর্ম সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ পেছন নয়; সামনের দিকে পথ চলা, নিশ্চিত গন্তব্যে আরও এগিয়ে যাও। নদীও তাই। জীবন্ত নদী বোবা কালা হলেও নদীর গন্তব্য নদী নিজেও কিন্ত ভালো জানে। নদী আসলে জন্মান্ধ সে কথা বলা যাবে না। নদীও আপন ছন্দে এঁকেবেঁকে, কখনোবা সমান্তরালভাবে চলে। তাই বলে নদীকে কখনো গন্তব্যহীন, ছন্দহীন বলা যাবে না।
সংগঠনগুলো গঠিত হয়েছে তার নিজস্ব গঠনতন্ত্র ও নিয়ামকের ওপর ভিক্তি করে। গঠনতন্ত্রে সংগঠনের সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য উল্লেখ রয়েছে। গঠিত সংগঠনের লক্ষ্য উদ্দেশ্যগুলো নামে টেকসই, জুটসই হলেও বহু গারো সামাজিক সংগঠন পথ চলায় ছন্দ কোন নেই; নেই কোন গতি। প্রাজ্ঞরা বলেন, যদি সে পথ চলায় গতি না থাকে তাহলে সে চলার পথে দুর্গতি অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়।
আমরা এও জানি, জীবনের কোনো উদ্দেশ্য না থাকলে তা নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। তেমনি উদ্দেশ্যহীন, গতিহীন, ছন্দহীন সংগঠন মানুষের জীবনে, সমাজে বিরুপ প্রভাব পড়তে পারে। দেখা দিতে পারে বিরোধ, বিভেদ, অরাজগতা, বিশৃঙ্খলা, সমন্বয়হীনতার মতোন নানা সামাজিক, ব্যক্তিগত কিংবা সাংগঠনিক সমস্যা। সর্বপরি জাতীয় ঐক্য তৈরিতে এটি একটি প্রধান অন্তরায়।
এহেন উদ্দেশ্যহীন জীবনের প্রভাব উদাহরণ হিসেবে টানা যেতে পারে। আগে বলে নিচ্ছি বলছি এটা কোনো মনগড়া কথা নয়। উদ্দেশ্যহীন জীবন ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক বলয়ে কেমন প্রভাব ফেলতে পারে এসব কিছু গবেষণায় উঠে এসেছে। দীর্ঘদিনের গবেষণার পর একদল স্নায়ুবিজ্ঞানী পরামর্শ দিয়েছেন, জীবনের একটি লক্ষ্য ঠিক করুন, দেখবেন নাকডাকা কিংবা অনিদ্রা দূর হয়ে গেছে। ঘুমের জন্য ওষুধের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে না। গবেষণাটি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ‘নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি’র একদল স্নায়ুবিজ্ঞানী। মোট ৮০০ জনের ওপর দুই বছর ধরে গবেষণা চালিয়েছেন তাঁরা। তাঁদের বয়স ৬০ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে। গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখার চেষ্টা করেছেন, জীবনের কোনো লক্ষ্য থাকা-না থাকার সঙ্গে ঘুমের সম্পর্ক আছে কি না। তাতে দেখা গেছে, যাদের জীবনের কোনো উদ্দেশ্য নেই, তারা অনিদ্রাসহ নানা সমস্যায় ভোগে। অন্যদিকে জীবনের উদ্দেশ্য আছে এমন ব্যক্তিদের এ জাতীয় সমস্যা নেই বললেই চলে। গবেষকরা বলছেন, এই গবেষণার ফল যেকোনো বয়সী মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে। গবেষক অধ্যাপক ড. জ্যাসন ওং বলেন, ‘জীবনের একটা উদ্দেশ্য খুঁজে বের করতে পারলে অনেককেই অনিদ্রার জন্য ওষুধের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে না।’
গারো সংগঠনগুলোর জীবন, যৌবন, উদ্দেশ্য, গতি নেই বলে বাংলাদেশে আদিবাসী স্বীকৃতি, আদিবাসীদের ভূমি অধিকার, মধুপুর, শেরপুর, সিলেটে গারোদের আবাসভূমি সমস্যা ফাইল বন্দি হয়ে আছে যুগের পর যুগ। এছাড়াও যেকোন আইনী সহায়তায় সরকারের উদাসীনতা বড্ড পিড়া দেয়, অসম্ভব যন্ত্রণা এবং বেদনার কথা।
দেশের অন্যান্য আদিবাসী সংগঠনগুলোর অবস্থাও তাই। জাতীয় পর্যায়ের আদিবাসী সংগঠন তাদের অবস্থাও যেন খালি তাদের দেহ আছে; কিন্ত যৌবন নেই। নানান সোর্স থেকে পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার পরও তাঁদের নৌকার পালে হাওয়া লাগে না। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দুয়েকটা দিবস পালন, মিটিং সিটিংয়ে আসন গ্রহণ, মিছিল মিটিং কিংবা প্রতিবাদ অনুষ্ঠানে সিনা টান করে রাজনৈতিক বক্তব্য ছাড়ার পর তাদের মাজায় জোর থাকে না এমন অবস্থা।
গারো সংগঠনগুলোর নির্বাচন, কাউন্সিল, নবীন বরণ, মিটিং মিছিল, নামমাত্র সামাজিক কিছু অনুষ্ঠানিকতা করে যুবকদের সামনে বন রুটিকে দিল্লির লাড্ডু বলে প্রলুব্ধ করলেই সংগঠনের শতভাগ সফলতা বলা যাবে না। টেকসই কিছু করতে হবে, এবং আমাদের সংগঠনের লক্ষানুযায়ী কাজ করা উচিত।
মোদ্দা কথা, গারোসহ আদিবাসী সংগঠনগুলোর দেহ কিংবা রুপে চকচকে জৌলুশ থাকলে হবে না। সংগঠনের নিভু নিভু প্রাণ থাকলে হবে না। দেহে পুরো যৌবন, জৌলুশ থাকতে হবে। দেহ মনে আত্মায় সে জৌলুশ আজীবন ধরে রাখতে হবে। তাতে শুধুমাত্র পরিবার, সমাজই উপকৃত হবে না। উপকৃত হবে গোটা গারো জাতি তথা দেশের আদিবাসী। সর্বপরি জাতিগত অধিকার আদায়ে বড় ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে।
আগামী ৯ আগস্ট ২০২৩ আদিবাসী দিবস সফল হোক।