বাংলাদেশে গেল সেপ্টেম্বর মাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলির মধ্যে কতগুলি ঘটনা খুবই জঘন্যতম। সেই সমস্ত জঘন্যতম ঘটনার মধ্যে যে কয়েকটি ঘটনা বাংলাদেশের শান্তি প্রিয় মানুষকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছে তার মধ্যে দুটি সমতলে এবং একটি পাহাড়ে। এগুলিতে কিছু মানুষের উগ্র সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মান্ধ মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের এই তিনটি ঘটনা একটি খাগড়াছড়ি, একটি সিলেট এবং ওপরটি টাঙ্গাইল মধুপুরে। মধুপুরের ঘটনা একটু ব্যতিক্রম হলেও বাকি দু’টি ঘটনা প্রায় মিল বলা যায়। কারণ দু’টি ঘটনায় বাংলাদেশের দু’জন নারী মানুষরূপী হিংস্র নরপুশুদের লালাসার শিকার হয়েছেন।

খাগড়াছড়িতে নিজ ঘরে মানুসিকভাবে অসুস্থ চাকমা আদিবাসী নারীকে নয়জন সেটেলার বাঙালী দ্বারা পালাক্রমে কয়েক ঘণ্টা ধর্ষিত হন। সিলেটের এম.সি কলেজে স্বামীর সামনে ধর্ষিত হন এক বাঙালী নারী। একজন পাহাড়ের আদিবাসী এবং আরেকজন সমতলের খোদ বাঙালী। সে ক্ষেত্রে আইন এবং বিচার একই হওয়া স্বাভাবিক।

মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দু’টি ঘটনার অপরাধীদের শাস্তি একই হবে। এবং একই হওয়া উচিত। একটি ঘটনার অপরাধীদের কঠোর শাস্তি এবং অপর ঘটনার অপরাধীদের কোন শাস্তি হবে না, তা চিন্তা করা যায় না। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা ও প্রশাসনের কাজ-কারবার দেখে দু’টি অপরাধের ঘটনা মনে হচ্ছে স্থানভেদে অপরাধীদের শাস্তির তারতম্য ঘটবে, ঘটবে কি ! সিলেটের ঘটনায় অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি হলেও খাগড়াছড়ি অপরাধীদের তেমন কোন শাস্তি হবে না, নয় কি!

খাগড়াছড়ি ধর্ষণের ঘটনায় নয়জন জড়িত থাকলেও এ পর্যন্ত মাত্র সাতজনকে পুলিশ ধরতে সমর্থ হয়েছে। বাকি দু’জনকে এখনো হদিস পায় নি। হদিস না পাবার পিছনে কোন কারণ রয়েছে কি? কারণ পাহাড়ে আদিবাসীদের ওপর কোন সেটেলার যে অপরাধ করুক না কেন প্রশাসনের কোন বাহিনী তাকে খুঁজে পায় না। অথচ মূল অপরাধীরা বীর দর্পে পুলিশের সামনে চলাফেরা করে। পাহাড়ে যত হত্যা, ধর্ষণ, লুট-পাট, জায়গা-বেদখল ও ঘরবাড়ি পোড়া বাঙালী সেটেলার দ্বারা সংঘটিত হয় তার কোন বিচার কখনো হয় নি। হাজার হাজার সেটেলার, আর্মি ও পুলিশের সাহায্যে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট করে; কিন্তু ধরার সময় আর্মি এবং পুলিশ কাউকে চিনতে পারে না। তাই পাহাড়ে কোন সেটেলারের বিচার হয় না।

ওপর দিকে সিলেটের পুলিশ তৎক্ষানিকভাবে গ্রেপ্তার করে আদালতে সমর্পণ করেছে। শুধু তাই নয়, ধর্ষকদের পক্ষে কোন আইনজীবী আদালতে হাজির না হওয়াতে পাহাড়সহ বাংলাদেশের সমস্ত শান্তিকামী মানুষ সিলেটের আইনজীবীদের সাধুবাদ জানিয়েছে। তাহলে বুঝা যাচ্ছে সিলেটের ধর্ষকেরা শাস্তি এড়িয়ে যেতে পারবে না। শাস্তি তাদের পেতেই হবে।

কিন্তু খাগড়াছড়িতে ধর্ষকদের ধামাচাপা দিতে প্রশাসনের লুকোচুরি খেলা দেখা যাচ্ছে। শুধু কি তাই? বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেখান থেকে লাখো লাখো মানুষ জ্ঞান ও শিক্ষা লাভ করে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে গুরুপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি তাঁদের ধর্ষণ বিরোধী বিবৃতিতে খাগড়াছড়ি বোনটির জন্য একটি শব্দও উচ্চারণ করে নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অনেক ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী শিক্ষক সমিতির ‘নারীর প্রতি সহিংসতা এবং নির্যাতনের প্রতিবাদ’ বিবৃতি দেখে বিস্মিত হয়েছেন। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন যে বিশ্ববিদ্যালয় দেশের মানুষের হৃদয়ের অন্ধকার দূর করে জ্ঞানের আলো জ্বালায় সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি কিভাবে সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মান্ধ হয়ে খাগড়াছড়ি ধর্ষিত বোনের জন্য একটি বাক্য না বলে চুপসে গেল! সরকারের স্বার্থ রক্ষা করতে নিজের আলোকিত বিবেককে কিভাবে দমিয়ে রাখলো? নাকি আসলে অজান্তে সাম্প্রদায়িকতার মুখোশ খসে পড়ে আসল চেহারাটা বেরিয়ে আসলো?

বলা বাহুল্য যে বাংলাদেশে মুখোশধারী উগ্র সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মান্ধ মনোভাব পোষণকারী বুদ্ধিজীবীর অভাব নেই। সম্প্রতি একজন মুখোশধারী বুদ্ধিজীবী জনসভায় হিন্দু এবং তাঁদের ধর্মকেও কটূক্তি করতে দ্বিধা করে নি। এ ধরনের নামধারী তথাকথিত বুদ্ধিজীবী মুখোশ পরা মানুষেরা নিজেকে যতই অসাম্প্রদায়িক মুখোশে লুকিয়ে রাখুক এধরনের জাতীয় বিষয়গুলিতে মুখোশ খুলে রাস্তায় নেমে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি, কিছু পত্র-পত্রিকার সম্পাদকও তাঁদের খোলস থেকে এই ধর্ষণ ঘটনায় বেরিয়ে এসেছে।

কোন সম্পাদক তাঁদের পত্রিকার সম্পাদকীয় কলামে খাগড়াছড়ি সেটেলার ধর্ষকদের কথা গুরুত্ব দিয়ে লেখেন নি। বেশিরভাগে বিষয়টি এড়িয়ে গেছে। নাকি কোন অজানা কারণে কলমে জোর ছিল না ! আপনাদের কলমের জোর এমনই যদি হয়, তাহলে পাহাড়ে সেটেলাদের দৌরাত্ম্য কমবে কিভাবে? পাহাড়ের মানুষ এবং নারী নিরাপত্তা পাবে কোথায়? দেশে কিভাবে জঘন্য অপরাধীরা শাস্তি পাবে?

এবার একটু মধুপুরের দিকে নজর দেয়া যাক। মধুপুরের বাসন্তী রেমার কলাবাগান ধ্বংস করা হল। দেশ-বিদেশে প্রতিবাদের পর তাঁকে আশ্বাস দেয়া হলো জায়গাসহ ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। ঠিক আছে। কিন্তু কবে, কখন? আর যে কর্মকর্তার নির্দেশে বাগান ধ্বংস করা হল তাঁর কি হলো? শাস্তি হলো না কেন? শুধু বদলি কি উপযুক্ত শাস্তি? আদিবাসীদের এভাবে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে সর্বহারা করা হয়। তবে আশার আলো একটাই। আপরাধী যতই বড় এবং ক্ষমতাশালী হোক শাস্তি তাকে একদিন পেতেই হবে। অন্যদিকে দেশের ছাত্রসহ শান্তিকামী মানুষ ধর্ম-বর্ণ ভুলে দেশের সব বর্ণের এবং ধর্মের মানুষ ধর্ষণের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে। দেশের পাহাড় এবং সমতলে প্রতিটি এলাকায় মিটিং-মিছিল হচ্ছে। আর তাদের সেই মিছিল-মিটিং-এর দাবীর পরিপেক্ষিতে পুলিশ খাগড়াছড়িতেও অপরাধীদের ধরতে বাধ্য হয়েছে। তবে আন্দোলন এখানে থামলে চলবে না। অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত সবখানে সবদিক দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।

পরিশেষে বলবো ধর্ষণ একটি জঘন্য অপরাধ। ধর্ষকদের রেহাই দেয়া যায় না। ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। বাংলাদেশ এবং বিশ্বকে ধর্ষণমুক্ত করতে হবে তা না হলে পৃথিবী কখনো সভ্য বলে কেউ দাবী করতে পারবে না। খাগড়াছড়ি ও সিলেটের ধর্ষিত বোনেরা সুবিচার পাক এবং ধর্ষকদের কঠিন শাস্তি দিয়ে দেশের মানবতা রক্ষা হোক। সেই সাভারের নীলা এবং মধুপুরের বাসন্তী রেমাকে ক্ষতিপূরণ করে জড়িত কর্মকর্তাকে উপযুক্ত সাজা দেয়া হোক। উগ্র সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মান্ধ মনোভাব আমাদের সোনার বাংলাদেশে চিরতরে পরাজিত হোক।