সাধারণত প্রথা বলতে- কোন জাতিগোষ্ঠি বা সমাজের সামাজিক চাল-চলন, আচার-আচরণের নিয়ম কানুন; যা আইনের মতোন পালন এবং মান্য করা বুঝায়। ব্যাপক অর্থে প্রথা হল, কোন সমাজে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা সেই সকল রীতিনীতি; যা সংশ্লিষ্ট আইনের কর্তৃত্ব বা আইনের মতো ক্ষমতাসম্পন্ন বিধি ব্যবস্থাকে বুঝায়। রীতিনীতি বা প্রথা হতে হলে অবশ্যই সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত হবে, দীর্ঘকালব্যাপি তা প্রচলন থাকতে এবং সমাজের লোকজন এটিকে আইনের মতো বাধ্যকর হিসেবে মান্য করবে।
ঠিক তেমনি গারো জাতির মূলবোধ, বৈশিষ্ট্য, সামাজিক প্রথা, রীতি-নীতিগুলো একদিনে গড়ে ওঠেনি। গারো জাতি সত্ত্বার সামাজিক রীতিনীতিগুলো খুবই সাদামাঠা। গারোরা মূলত প্রাকৃতিক নির্ভর জীবন। তবে একজন মানুষ হিসেবে যে গুণ বা মনোবৃত্তি থাকা প্রয়োজন তা গারোদের মধ্যে সব মূলবোধগুলো উপস্থিত এবং স্বতন্ত্রভাবে বিদ্যমান।
গারোরা প্রকৃতিগতভাবে অতিথি পরায়ন। ফলে গারোদের অন্যতম সামাজিক চু পরিবেশনের পত্রিয়া বা আচারগুলো এক কথায় অসাধারণ। এ ধরণের সামাজিকতা যেকোন জাতিগোষ্ঠিকে মুগ্ধ করে এবং গারো সামাজিক আনুষ্ঠানিকতায় বাড়তি আর্কষণ বললে অত্যুক্তি হবে না, এ যেমন গারো চু প্রস্তুত বা পক্রিয়া এবং চু পরিবেশন।
চু প্রস্তুত এবং পরিবেশনের প্রক্রিয়া- যে স্থানে চু দিকথম নিয়ে চু প্রস্তুত করে তাকে বলা হয় দিকখল। যিনি চু প্রস্তুত করেন তাকে বলা হয় দুচেকগুবা। প্রথমে চুচেকগুবা দিকথমের (চু পাত্র) ঢাকনা খুলে জান্তি বরাবর যেটুকু স্থি বা ভাতের সমপরিমান পানি ঢেলে দিতে হয়। তারপর ফং দিয়ে পানি তুলে স্থি-এর উপর ঢেলে দিতে হয়। এভাবে তোলা-ঢালা করতে করতে চু পানের উপযোগী হয়। তারপর আরেকটি পাত্রে (অনচাক্রা বা দনচাক্রা) জমিয়ে পরে সেটি বড় ফং অথবা জগ (যাকে বলা হয় রনচাক্রা) দিয়ে সবার জন্য নির্ধারিত গ্লাসে (যাকে বলা হয় দাম্বি) ঢেলে দিতে হয়। চু পানের সময়েও গারোরা কিছু আচার মেনে চলে; যেমন-
•সাধারণত যেকোন চু পানের সময় সকলেই গোল হয়ে বসেন।
•চ্রা এবং মুরুব্বী শ্রেণীর লোকজন দিকখলের কাছে এবং ডানপাশে সারিবদ্ধ হয়ে বসবেন।
•চুচেকগুবা চু প্রস্তত করার সময় দিকথমে তার হাঁটু স্পর্শ করতে পারে না।
•চু চেকগার সময় যাতে চু/পানি ঢালা/তোলার শব্দ যেন না হয়।
•সর্বপ্রথম বাড়ির কর্তা, তারপর সবচেয়ে মুরুব্বী এবং চ্রাদেরকে চু পরিবেশন করতে হয়।
•চু পরিবেশনের শুরুতে বিনয়ের সাথে পান করতে প্রস্তাব দিয়ে একই গ্লাসে সকলের জন্য ফং থিসা বা এক গ্লাস করে খাইয়ে দিতে হয়।
•সর্বপ্রথম চু পান করানোর সময় অবশ্যই আগে ফং বা গ্লাস থেকে কয়েক ফোটা করে মাটি এবং দেবতাদের উদ্দেশে অল্প পরিমানে মাটিতে ফেলে তারপর খাওয়াতে হয়। তারপর উপস্থিত লোকজনকে খাওয়ানোর নাম- খানচিকা। এরপর উপবেশনকারি দাম্বি (সবার জন্য একটি করে নির্দিষ্ট গ্লাস) ভরে চু ঢেলে রেখে যেতে হয়।
•যিনি চু বিতরণ করছেন বা পান করাচ্ছেন তাকেও একগ্লাস বা কিছু পরিমান খেতে অনুরোধ করা বা খাইয়ে দেওয়া ভদ্রতার পরিচায়ক।
•খাজি প্রস্তুত হলে আগে অল্প খাজি (১/২ মাংসের টুকরো) খাইয়ে তারপর চু এক গ্লাস খাওয়াতে হয়।
•যতোই তৃষ্ণা বা সক্ষম হোক না কেন, একবারে দাম্বির পাত্র বা গ্লাস খালি করে খাওয়া অশোভন ও অসম্মানজনক।
•দাম্বির (ব্যক্তির জন্য নির্ধারিত) গ্লাসের চু শেষ হওয়ার আগেই সেই গ্লাস ভরে চু ঢেলে দিতে হয়।
•অনেকে চু কম খান, সেক্ষত্রে আর খাবেন না বলে গ্লাস একবারে খালি করে খাওয়া অশোভন। না খেলেও বা খেতে না পারলেও নিজের গ্লাসে চু রেখে দিতে হয়।
•খাওয়ার আসর থেকে কেউ চলে যেতে চাইলে সবাইকে জানিয়ে (বা বিদায় নিয়ে) নিজের গ্লাসটি দিকখলে জমা দিয়ে যাওয়া ভদ্রতার লক্ষণ।
•দায়িত্ব শেষ না করে বা সকলের চলে না যাওয়া পর্যন্ত চু-চেকগুবা চলে যেতে পারেন না। যদি স্থান ত্যাগ করতেই হয়, তাহলে অন্য একজনকে বসিয়ে তারপর যেতে পারবেন।
•অকারণে অপ্রাসঙ্গিক কথা উত্থাপন করে খাওয়ার আসরে গোলযোগ সৃষ্টি করা অমার্জনীয় অপরাধ।
•চু খাওয়ানো বা খাওয়ার সময় (অথবা কোন কারণে স্থান পরিবর্তনকালে) অসতর্কভাবে কারোর গ্লাসের চু বা গ্লাস, খাজি ইত্যাদি ফেলে দেওয়া, কারো শরীরে বা পায়ে পা দিয়ে স্পর্শ বা আঘাত করা চরম অপরাধ।
•খাওয়ার স্থানে, কারোর বাড়িতে চু খেয়ে মাতলামি করা এবং বমি, প্রস্রাব, পায়খানা করে ফেলা অমার্জনীয় অপরাধ, একারণে অর্থদণ্ডও হতে পারে।
গারো সমাজ কাঠামোতে রয়েছে স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য। সুন্দর সামাজিক জীবন সব সময়ই আনন্দময়। মাঝে মাঝে সবারই একা লাগে। ফলে সামাজিকতা এবং সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় থাকা জরুরী। দীর্ঘদিন সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকা আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। গারোদের আতিথিয়তা, সামাজিক আচার, চু পক্রিয়া বা পরিবেশন এখনো আমাকে সত্যিই মুগ্ধ করে।
লুই সাংমা, ফ্রান্স
ওয়েভ ডেভেলপার, ব্লগার, ফ্রিল্যান্সার এবং সাংস্কৃতিক কর্মী