গারোদের সামাজিক প্রথা অতি প্রাচীন। এ সামাজিক প্রথাসমূহ এখনো যথাযত বলবৎ থাকলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিথিলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মূলত গারোদের সমাজ ব্যবস্থা পরিচালিত হয় মাতৃতান্ত্রিক পদ্ধতিতে; এটাই প্রচলিত বাক্য। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার রীতি-নীতিনুসারে গারো পুরুষেরা বিয়ের পর তাঁদের স্ত্রীর পরিবারে থাকেন। গারো পুরুষেরা সম্পত্তির মালিক হতে পারেন না। মায়ের পদবি ও পরিচিতিতেই সন্তানরা পরিচিত হয়। গারো সমাজ বা পরিবার নারী দ্বারা শাসিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়; মা বা নারীকেই পরিবারের প্রধান বা চালক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গারো পরিবারে পুরুষের ভূমিকা নেই তা নয়; থাকলেও তা খুবই সীমিত ইত্যাদি আলোচনা, সমালোচনা এবং বিভিন্ন গ্রন্থে লেখালেখি হয়ে আসছে।
প্রচলিত গারো রীতি অনুসারে সম্পত্তির মালিক যেমন কোন পুরুষ হতে পারে না; ঠিক তেমনই সম্পত্তির প্রকৃত মালিক একক কোন নারীও নয়। বরং বলা যায় সমূহ সম্পত্তির মালিক গোষ্ঠী বা চাচ্চি। কারণ, কোন জমির মালিক কোন মেয়ের হলেও বিশেষ করে চ্রা-দেফান্তেদের (পুরুষের) অনুমতি বা সমর্থন ব্যতীত সেই সম্পত্তি কাউকে ভাগবাটোয়ারা বা হস্তান্তর এবং ক্রয়-বিক্রয় করতে পারেন না। পরিবারের ভাই, মামা, আচ্চু, ভাগ্নে অর্থাৎ চ্রাদের নিয়ে মানকপক্ষের (মা, বোন, নানী, মাসী, জ্যাঠি, ভাগ্নি এবং তাদের স্বামী অর্থাৎ পুরুষসহ) সকলে মিলেই তা হস্তান্তর বা বিক্রয় করতে পারেন।
পরিবার এবং সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে গারোরা সামাজিক শিষ্টাচারসমূহ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে মেনে চলে। গারোদের উল্লেখযোগ্য কিছু প্রথা রয়েছে, যেমন- (ক) খিম/হাখিম প্রথা, (খ) নকনা-নক্রম প্রথা, (গ) মাহারি-মাচং প্রথা, (ঘ) আগাত্তে/আগাথে-চাওয়ারি প্রথা, (ঙ) চ্রা প্রথা, (চ) মানক প্রথা(ছ) জিকচল প্রথা ইত্যাদি।
গারোদের সামাজিক প্রথাগুলো অলিখিত; কিন্তু এই গারো সমাজের বিধি-ব্যাবস্থাগুলো এখানো তাদের সমাজ ব্যবস্থায় স্থিতিশীল রাষ্ট্রীয় আইনের মতোই মান্য করে। গারো সামাজিক প্রথাসমূহ মাচং বা মাহারি প্রথা অন্যতম।
গারোদের সাংমা বা মারাক হচ্ছে প্রধান মাহারি (গোত্র); আর এ (সাংমা বা মারাক) মাহারিদের অধীনে থাকে মাচং/চাচ্চি বা উপগোত্রসমূহ; যেমন- ম্রং, নকরেক, মৃ, সিমসাং, দফো, রিছিল, চিরান ইত্যাদি। দফো মাহারি হলে দফো চাচ্চিরা সর্বাগ্রে শুধু দফোদের বিষয়ে বা স্বার্থ চিন্তা করবেন, গুরুত্ব দিবেন-এটাই স্বাভাবিক। অন্যান্য (মাগুব্বুনগুলোও) গোত্রধারীরা একইভাবে নিজ নিজ মাচং বা গোষ্ঠীর জন্য কাজ করেন। ধরুন, যদি সকলেই নিজ নিজ মাচং বা গোষ্ঠীর স্বার্থ চিন্তা করেন, তারপর ক্ষেত্র বিশেষে যদি প্রয়োজন পড়ে তখন (সাংমা বা মারাক) মাহারির জন্য কাজ করেন। বাস্তবতায় আমরা যা দেখি, তাহলো গুরুত্ব দিচ্ছি বা কাজ করছি দফো মাচং (নিজ গোষ্ঠীর)-এর জন্য, অথচ নাম ফুটছে বৃহৎ সাংমা-মারাকের। এ কারণে প্রচলিত মাহারি প্রথাকে ‘মাহারিপ্রথা’ না বলে ‘মাচংপ্রথা’ বলাই অধিক যৌক্তিক মনে হয়। কারণ, আমরা বেশ কয়েকজন প্রবীন ব্যক্তিদের সাথে বিষয়টি সম্পর্কে আলাপ করে জানা যায়, স্কাংদে মাচং আর মাহারিখো একিন (Same) ইন্নারিনমুং, হিনানা ‘মাহারিপ্রথা’ ইন্নাবা। আবার অনেকেই বলেছেন, বিবিগিত্তা ইন্না রেআঙোদে ‘মাচংপ্রথা’-আন হঙাদে হংনমুংখন’ বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। গারো প্রবীনদের যুক্তি মোতাবেক এই সামাজিক ব্যাবস্থাকে মাহারিপ্রথা না বলে মাচংপ্রথা বলাই শ্রেয় বোধয়।
যে প্রথাগুলো গারো সমাজ ব্যবস্থায় বিদ্যমান ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সমাজ ব্যবস্থায় এটি অদ্ভূদ মনে হতে পারে। নিজ নিজ মাহারি বা মাচংদের মধ্যে সুশৃঙ্খলভাবে পরিবার ও সমাজ জীবন নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনা করা হয় এ প্রথার মাধ্যমে। পূর্ব পরিচয়হীণ কোন ম্রং পৃথিবীর আরেক প্রান্তে গিয়ে কোন ম্রং মাচংকে পেলেও তারা আপন ভাই অথবা বোনের মত (অথবা বয়োজ্যাষ্ঠ হলে মামা, আম্বি, আচ্চু, আজং, মাসি ইত্যাদি ) হয়ে যাবেন, এটাই মাচং প্রথা। বলা যায়, এটি গারো জাতির মূল্যবোধ, যা সকলেই এটিকে দ্বিধাহীন এবং বাধ্যগতভাবে মেনে আসছে যুগের পর যুগ। এই প্রথার বিশেষত্ব হচ্ছে, মৃ এবং সিমসাং সাংমা গোত্রের হলেও কোন মৃ’র বিচার-আচার, সহায় সম্পত্তি সিমসাং-এর কাছে যাবে না বা হস্তান্তর হবে না। অন্যদিকে, মাহারি বা মাচং প্রথার সূত্র ধরে কোন পরিবারের কর্তার বা শ্বশুরের মাচং (বা আপন বা গোষ্ঠীর ভাগ্নে হলে) ধারি জামাতা হলে, বিশেষ ক্ষেত্রে সে নক্রম পদের জন্য দাবী করতে পারেন। এই ক্ষেত্রে উক্ত শ্বশুর যদি উপযুক্ত কারণ ছাড়া অন্য মাহারি/মাচং-এর জামাতাকে নক্রম মনোনীত করতে চাইলে নিজ মাচং/মানকের সাথে তুমুল বাকবিতণ্ডা বাঁধতে দেখা যায়। অনেক সময় সাল্লেগা (ছেলে/জামাইকে ফেরত নেওয়ার) উপক্রম হয়। কেননা, শ্বশুর নিজের চাচ্চিকে/ভাগ্নেকে নক্রম করতে আপত্তি করলে তার (জামাই/ভাগ্নে ও শ্বশুরের-এর) মাহারি/মা.নকেরা মাহারিগতভাবে যে অধিকার থাকে, সে অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং নিজ মাহারিকে অবমাননার সামিল মনে করা হয়। শুধু তাই না, মাহারিগতভাবে এই চরম অবমাননা, অপমানবোধ করার কারণে মাচং/মানকের সাথে তুমুল বাকবিতণ্ডা বেঁধে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
গোষ্ঠীর ভেতরে কেউ অন্যায়, দুর্নীতি করতে দেখলে নিজ মাচংদের মধ্যেই শাসন বা সমাধান করা হয়। কোন কারণে অন্য মাচং বা মাহারিদের সাথে দ্বন্দ্ব এমন কি বিচার সালিসের প্রয়োজন হলে সেখানে নিজ গোষ্ঠীর সকলেই যার যার মাচং-এর পক্ষ নিয়ে কথা বলবেন। বিচারে কেউ বিজয়ী বা দোষী সাব্যস্ত হলে গোষ্ঠীর সকলেই এর ভাগীদার হবেন। এমনকি, বিচারে জরিমানা প্রদানের ক্ষেত্রেও গোষ্ঠীর সকলে মিলে উক্ত জরিমানা পরিশোধ করা হয়। মাহারি বা মাচং-এর মধ্যে যিনি বয়োজ্যাষ্ঠ এবং অভিজ্ঞ, তিনিই ঐ মাচং-এর পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন। উক্ত সবসময়ই তার মাচং গোষ্ঠীর মধ্যে একতা, উন্নতি ও সম্প্রীতির জন্যে উদারভাবে দায়িত্ব পালন করেন। এই মাহারি বা মাচং প্রতিনিধিগণ অন্যান্য গোষ্ঠীর কাছে গেলেও নিজগোষ্ঠীর পক্ষে সবসময়ই বিশেষভাবে সম্মানিত হয়ে থাকেন।
গারো জাতিগোষ্ঠী বা সমাজের সামাজিক চাল-চলন, আচার-আচরণের নিয়ম কানুন; যা আইনের মতোন পালন করে আসছে দীর্ঘকাল। ফলে গারো সমাজ ব্যবস্থায় দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা সেই সকল রীতিনীতি; যা সংশ্লিষ্ট আইনের কর্তৃত্ব বা আইনের মতো ক্ষমতাসম্পন্ন বিধি ব্যবস্থা বিদ্যমান। গারো সমাজের রীতিনীতি বা প্রথা অবশ্যই সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত, এবং দীর্ঘকালব্যাপি প্রচলন হয়ে আসছে এবং গারো সমাজের লোকজন এটিকে এখনো আইনের মতোন মান্য করে। তথ্য: গারো সংস্কৃতির মাধুর্য (প্রকাশিতব্য)