প্রগতিশীল, চিন্তাবিদ এবং লেখকদের বলা হয় জাতির বিবেক৷ গারো জাতিসত্তার সামগ্রিক সমস্যা তথা বর্তমান সামাজিক সঙ্গতি, অসঙ্গতি, জাতিগত জাতীয় ইস্যূ নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা সমালোচনা করার রেওয়াজ যেন নিশ্চল। জানি না কেন এমন অদৃশ্য অশুভ শক্তি ভর করেছে গারো সমাজেও।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যে বুদ্ধিজীবীদের কথা জানি, বই পুস্তকের সংজ্ঞায়, ইতিহাসে যেসকল বুদ্ধিজীবীদের অবদান দেখতে পাই সেই মানের ও চিন্তার বুদ্ধিজীবী আমাদের গারো সমাজেও একেবারে নেই যে তা নয়, আছে। ব্যতিক্রম শুধু ওঁরা প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী, কিংবা কোন দলীয় বা গোষ্ঠির হয়ে কাজ করে। কোন রাষ্ট্রের, সংগঠনের এজেন্ডা বাস্তবায়নে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখে। ইদানিং লক্ষ্য করছি গারো লেখক, অনিবন্ধিত বুদ্ধিজীবী হলেও জাতির সংকটময়ে কেন হাত পা গুটিয়ে, মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন এটিই তারকা চিহ্ন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একটা সময় এও দেখেছি একদল অন্যায় করলে অন্যদলের লেখক, বুদ্ধিজীবীরা কথা বলতেন৷ কিন্তু এখন কেউই কথা বলেন না। সমাজে নিজের চোখে অন্যায় অনাচার দেখেও যেন কিছুই দেখেন না। সবাই চুপচাপ হয়ে গেছেন৷ যার ফলে আমার যা মনে হয় আমাদের প্রজন্ম চুপচাপ থাকাকেই স্বাভাবিক মনে করছে৷ সমাজে অন্যায়, অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সংস্কৃতি একেবারে হারিয়ে যাচ্ছে৷।
আমার মতে, বাংলাদেশের গারো লেখক, বুদ্ধিজীবীদেরও একটি ঘরানা থাকা উচিত। গারো আদিবাসীরা সংখ্যালঘু। তবে দেশের প্রায় প্রতিটা সেক্টরে এদের বিচরণ দেখা গেলেও সরকারি, বেসরকারি, রাজনৈতিক কিংবা গারো মাহারিগত টানের দরুন গারো লেখক, বুদ্ধিজীবী তাদের ভূমিকা পালন করছেন না৷ জাতির প্রয়োজনে তাঁদের কাছ থেকে কোন দিক, গঠকমূলক পরামর্শ বা নির্দেশনা পাওয়া যায় না৷ যার ফলে আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ যা বলে, তাঁদের এই নিষ্ক্রিয়তা সমাজ তথা দেশের অগ্রগতি ও প্রগতির পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে। দুরে ঠেলে দিচ্ছে জাতিগত মহান এবং সম্ভাবনাময় জনস্বার্থগুলোকে।
আবার যে গুটি কয়েক গারো লেখক, বুদ্ধিজীবী এবং প্রগতিশীল যুবক জাতির স্বার্থে সিনা টান করে কথা বলেন তাদের গঠনমূলক আলোচনা, সমালোচনা এমন কি বিভিন্ন লেখনী দিয়ে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন তাদেরকেও সমর্থন করি না। কারণ সেখানে অনেক স্বার্থসহ মোটা দাগের ডিলেমা আছে। অর্থাৎ তাঁদের প্রশংসা, মান সম্মান ক্ষুন্ন হবে, কেউ বিপদে পড়ার, কেউ আবার সুযোগ সুবিধা হারানোর ভয়ে বেলুনের মতোন চুপসে থাকেন৷ সমাজের ও জাতির প্রয়োজনে তাঁরা কোনো কথা বলেন না৷ আবার যাঁরাও দুয়েকটি কথা বলেন তারা দলীয় কিংবা স্বার্থের উর্বেধ, মাহারি, স্বজন গন্ডির বাইরে যেতে পারেন না৷ নিজ স্বার্থের উর্বেধ উঠতে পারেন না।
এহেন প্রসঙ্গত একটি কথা উল্লেখ করা যেতে পারে যেমন, TWA সংক্রান্ত সাম্প্রতিক গণমাধ্যমে উত্তাপিত ইস্যূ এবং ভার্চ্যুয়াল আলোচনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকি বহাল ছিলাম না। ব্যক্তিগতভাবে আমার আগ্রহও ছিল না। TWA সম্পর্কে আগ্রহ না থাকার কারনও অনেক থাকতে পারে আমার মতোন অনেকের। যা হোক সেই ভার্চ্যুয়াল আলোচনায় বিভিন্ন আলোচকবৃন্দের আলোচনা এ টু জেট শুনছিলাম। সেখানে অধ্যক্ষ অঞ্জন ম্রং’য়ের কংক্রিট যে বক্তব্য, সে বক্তব্য শুনে আজকের মতামতটিও লিখতে আমাকে বাধ্য করেছে। তিনি সেখানে সে প্রতিষ্ঠানের সংবিধান থাকার পরও মেয়াদ উত্তীর্ণ পর্ষদ কিভাবে অসাংবিধানিক, অসাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়েছে এবং সর্বপরী দ্রুত করণীয় বিষয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট বাক্য তুলে ধরেছেন, প্রতিবাদের যে সুর তিনি তুলেছেন আমি ব্যক্তিগতভাবে সমর্থন করি। এবং যেকোন সচেতন নাগরিক, প্রগতিশীল মানুষদের সমর্থন করা উচিত। TWAর মতোন জাতীয় সংগঠনের কার্যক্রম এমন বেহাল দশা হতে পারে না, হওয়া উচিত নয়। যে সংগঠনটি প্রবীন এবং নবীনদের সমন্বয়ে গড়া এটি কি করে ভগ্ন দশায় পরিনত হয়, আপনাদের হয় কি না জানি না কিন্ত আমার বোধগম্য হয় না।
তদ্রুপ আরেকটি জাতীয় ইস্যূ নিয়ে অরেকটু কথা বলা যেতে পারে, অতি সাম্প্রতিক সময়ে মধুপুরের গারো অধ্যুসিত এলাকার একটি প্রাচীন মাংরুদামকে নিয়ে ঘটে যাওয়া এবং সেখানে চলমান, বাস্তবায়নকৃত আরবোরেটাম প্রকল্প উদ্বোধনক, প্রকল্পের নীল নকশাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতি গারো ইতিহাসের আরেকটি দু:খজনক, কালো অধ্যায় ছিল বলে অনেক নবীন প্রবীন তা মনে করেন। উক্ত প্রকল্প বাস্তবায়নে জয়েনশাহী উন্নয়ন পরিষদের কিছু ব্যক্তি সরাসরি, অথবা পরোক্ষভাবে সহায়তা করে আমাদের জাতীয় নেতৃবন্দ যে উদাসীনতা দেখিয়ে ইকোপার্ক আন্দোলনকে ব্যহত তথা জাতির জাতীয় স্বার্থকে খাদের কিনারে নিয়ে গেছে বললে একেবারেই অত্যুক্তি হবে না।
এদত বিষয় লেখার আমার উদ্দেশ্য হলো, আমাদের জাতীয় পর্যায়ে নেতা, মরুব্বি সংগঠনগুলো কিভাবে এ ভূল করেন। ধরে নিলাম মানুষ মাত্রই ভুল করে। বিপদগামী নেতা-নেত্রীরা হয়তো এমন অপ্রত্যাশিত ভুলের শিকার হয়। যদি তাই হয় তাহলে গারো সচেতন লেখক সমাজ, বুদ্ধিজীবীরা কেনইবা নির্জীব, নিষ্ক্রিয় থাকেন ? অথচ ফেবু বা গণযোগাযোগ মাধ্যমে দেখবেন গারো সমাজের কিছু বুদ্ধিজীবী, প্রথিতযশা কিছু লেখক, কলামিষ্ট সেখানে সরব থাকেন। তুচ্ছ ঘটনা, অপ্রয়োজনীয় বিষয়কে তারা জরুরি মনে করেন। অঢেল সময়, অর্থ, মেধা ব্যয় করেন। সেই গারো বুদ্ধিজীবী, লেখক জাতির ক্রান্তিকালে এঁরা কেন পাশে নেই, এঁরা কেন কোন পরামর্শ দিতে ব্যর্থ হয়!
আমার ব্যক্তিগত অবর্জাবেশান বলে, গারো সমাজের কিছু লেখক, নেতা এসব সংগঠন, রাজনীতির সঙ্গে সংযুক্ত বলে জাতীয় ইসূগুলোতে এরা বোবা কালা বনে যায়। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি থাকে অন্যকোনখানে। এভাবেই জাতীয় ইস্যূগুলোতে লেখক সমাজ, বুদ্বিজীবী, সংগঠন এবং কিছু নেতাদের ভূমিকা সন্দেহাতীতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে দিনের পর দিন। যার ফলে বাংলাদেশে আদিবাসী তথা গারোদের অধিকার, উন্নয়ন স্বাধীনতার পূর্ববর্তী এবং অধ্যাবধি অগ্রগতি ঐ গোলা ঘরের তলানিতেই রয়ে গেছে। গারো লেখক সমাজ, বুদ্বিজীবীরা কিছু নেতা বা সংগঠনের ভূমিকা নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা সমালোচনা নেই বলেই অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, দুরদর্শিতার অভাবে সরকারি-বেসরকারী অনুদান, বিদেশি দাতা সংস্থার সহায়তা কিংবা অনুদান মূলভোক্তভোগীর কাছে সঠিকভাবে পৌঁছায় না। উন্নয়নের সর্বোচ্চ লক্ষমাত্রায় পৌঁছাতে পারে না।
গারো লেখক, বুদ্ধিজীবীদের নিস্ক্রিয়তা, গারো নেতাদের এই যে হরহামেশা ভুল কিংবা রাজনৈতিকভাবে সেই সময়ে নিজেদের অবস্থান প্রদর্শন গারোদেরকে নিজেদের কাছেই নিজেদেরকে নানাভাবে পরাভূত করে রেখেছে। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন কিংবা বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন করেও সেই ভুল থেকে প্রজন্মরা উঠে আসতে পারছে না। ফলে ওই একই চক্রে, খাদে গিয়ে সর্বদা নিমজ্জিত হচ্ছে তারা। জাতির কঠোর আন্দোলন সংগ্রাম ও রক্তের বিনিময়েও দাবি-দাওয়া আদায় হচ্ছে না। জাতীয় এই সব কারণেই আমরা বড় ধরনের সংকটের মধ্যে আছি৷ আমরা সামগ্রিক একটা ভয়ঙ্কর নীরবতা লক্ষ্য করছি৷ কোনো অন্যায় বা অপকর্মের বিরুদ্ধে আমরা স্পষ্ট ও সোচ্চার কোনো প্রতিবাদ এখন দেখি না৷ আমি মনে করি এটা গারো লেখক, বুদ্ধিজীবীদের নীরবতার কারণেই হচ্ছে৷
তথ্য প্রযুক্তির যুগে সামাজিক যুগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মিডিয়াতেও গারো লেখক, বুদ্ধিজীবীদের মেধাগুলোকে সমন্বয় করে আরো জোড়ালো ভূমিকা থাকার সুযোগ ছিল। বর্তমান বাস্তবতায় যা দেখি কিছু গারো লেখক, বুদ্ধিজীবী নিশ্চুপ থেকে প্রশংসা কুড়াতে ভালোবাসেন। জাতির সংকটময় মহুর্তে, প্রয়োজনে ওঁরা নিস্তবদ্ধ, বাকরুদ্ধ হয়ে থাকে। দায়ছাড়া ভাবকেই স্বাভাবিক মনে করেন, যা সত্যিই গারো জাতির জন্যে দু :খজনক বিষয়।
লুই সাংমা, ফ্রান্স
ওয়েভ ডেভেলপার, ব্লগার, আন্তর্জাতিক ফ্রিল্যান্সার এবং
সাংস্কৃতিক কর্মী, lchiran76@gmail.com