গ্রাম্য প্রবাদে আছে ‘পান্তাভাতের জল, তিন পুরুষের বল’। গাঁজায়িত ভাত বা পানি ভেজানো ভাতকে ‘পান্তা ভাত’ বলে থাকি। গ্রাম বাংলার অধিকাংশ শ্রমজীবীদের কাছে বহুল প্রচলিত, সুস্বাদু এবং জনপ্রিয় খাবার। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিম বাংলা, আসাম এবং উড়িষ্যায় এটি খুবই জনপ্রিয় খাদ্য। দেশের বিভিন্ন উৎসব যেমন পহেলা বৈশাখ, বা বাংলা নববর্ষের উৎসবে পান্তা ভাত খাওয়া রেওয়াজ এখন বাঙালি সংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে উঠেছে। উৎসবে কেউবা সখের বসে, আবার কেউবা গ্রাম্য খাবারের অতীত স্বাদ নিতে এমন বিশেষ দিনে ঘরোয়া পরিবেশে বা উৎসবে ভিন্ন খাবারের আয়োজন করে পান্তা ভাত খেতে দেখা যায়। শহরের মানুষের কাছে এটি পান্তা-ইলিশ বলেও বহুল সমাদৃত হয়ে আসছে। বাঙালির পহেলা বৈশাখ, বা বাংলা নববর্ষের উৎসবে পান্তা ছাড়া উপাদেয় হয় না।

পান্তা তৈরি প্রক্রিয়া-  পান্তা তৈরি করতে সাধারণ খাবারের মতোন ভাত রান্না করলেই চলবে। তবে পান্তা তৈরি করতে বিশেষ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। সচরাচর লোক লোকালয়ে রাতের খাবার বেশি হলে অথবা প্রয়োজনে নাস্তার জন্যে বেশি ভাত রান্না করে, ভাত ঠান্ডা হলে সে রাতে ভাতের হাড়িতে পরিমাণ মতোন পানি ঢেলে পাতিল ঢেকে রাখা হয়। অর্থাৎ ৭/৮ ঘন্টা রান্না ভাত পানিতে ভিজিয়ে গাঁজন পক্রিয়ায় রাখা হয়। খাবারে বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার না করলে খাবারটি ক্ষতিকারক ব্যাক্টরিয়ায় পরিনত হতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সকল চালে পান্তা ভাত তৈরি করা যায়; তবে আউশ ধান বা লালচে রঙ চালের ভাতে পান্তা বেশি সুস্বাদু।

পান্তা কিভাবে খাবেন- সাধারণত লোকালয়ে শ্রমজীবীরা খায় পান্তা ভাত সামান্য লবন, কাঁচা বা শুকনো মরিচ ভাজা, সাথে কাঁচা পেঁয়াজ আর খাঁটি শরিষা তেল। তবে শহরের ভোজন বিলাসীরা আলু ভর্তা বা যেকোন ভর্তা, শুটকি ভর্তা, ইলিশ মাছ ভাজা অথবা যেকোন চার্টনি, তারকারির ঝোল, সাথে সামান্য লেবু দিয়ে খেতে বেশি পছন্দ করে।

পান্তাভাতে পুষ্টিগুণ- পান্তা ভাতকে সাধারণত গরীবের খাবার বলা হয়। তাই সবার ধারণা পান্তা ভাতে কোন পুষ্টিগুণ নেই। পান্তাভাত বা গাঁজন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে হাইড্রোলাইসিস (পানির সংগে রাসায়নিক বিক্রিয়া) এর মাধ্যমে উৎপাদিত ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এর পুষ্টি-শোষণ বিরোধী ফ্যাক্টর (যেমন-ফাইটিক এসিড) ভেঙ্গে যায়। ফলে পান্তাভাতের অনুপুষ্টি/খনিজ উপাদানগুলো মুক্ত হওয়ার ফলে খাদ্য গুণাগুণ, ও স্বাদ বেড়ে যায়। বিজ্ঞানীদের গবেষণার তথ্য মতে পান্তা ভাতে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান। ২০১১ সালে ‘দি টেলিগ্রাফ্ ইন্ডিয়া’তে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী আসাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি জীব প্রযুক্তি বিভাগ কর্তৃক পান্তাভাত নিয়ে এক গবেষণায় পান্তা ভাতের অনেক উপকারিতা সম্পর্কে জানা যায়, যেমন যে পুষ্টিগুণগুলো রয়েছে-  ক) আয়রন, খ) ক্যালসিয়াম, গ) পটাশিয়াম, ঘ) সোডিয়াম, এবং ঙ) জিংক ইত্যাদি।

পান্তাভাত খাওয়ার উপকারিতা- পান্তা ভাত সহজে হজম  করে। খাবারের স্বাদও বেড়ে যায়। গাঁজনকৃত ভাত খাদ্যনালীর প্রদাহ উপশম করে। তীব্র তীব্র দাবদাহে শরীরের তাপের ভারসাম্য বজায় রাখে। এ ভাত কোষ্ঠ-কাঠিন্য দূর করে। শরীর ঝরঝরে রাখে। ব্লাডপ্রেসার কমায় ও মানসিক প্রশান্তি আনে। খাওয়ার পর মানুষের শরীরে দ্রুত শক্তি বা বল পেতে সাহায্য করে।

শহুরে, গ্রাম্য পান্তাভাতের স্বাদ কিছুটা তফাৎ লাগে। শহরে মানুষ পান্তা গিলে সখে। বিলাসীপনা করে খায়। আর গ্রামের মানুষ পান্তা খায় অভাবে, মিতব্যয়ী বা কম খরচে দ্রুত বল জোগায়। গ্রামে পান্তা খায় সাধারণত সকালের নাস্তা হিসেবে; অথবা বাড়িতে কোন বিশেষ কিছু তরকারী আয়োজন না থাকলে। এটি তাদের দ্রুত শক্তি বর্ধক খাবার হিসেবে কাজ করে।

মোদ্দা কথা, পান্তাভাতে বেশি পরিমাণে আয়রন, ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়াম আছে। দ্রুত শক্তি জোগায় বলে কায়িক পরিশ্রম করা মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে পান্তাভাতের সুফল দেয়। এ খাদ্যে শক্তিশালী শর্করা থাকার ফলে দ্রুত শক্তি জোগায়। এটিকে স্যুপ জাতীয় খুব এনার্জেটিক খাবার বলা যেতে পারে। পান্তা খেলে দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা থাকে। নিয়মিত পান্তা খেলে শরীরে কোন ক্ষতি নেই।

লুই সাংমা, ফ্রান্স
ওয়েভ ডেভেলপার, ব্লগার, আন্তর্জাতিক ফ্রিল্যান্সার এবং
সাংস্কৃতিক কর্মী।