মধুপুর শালবন প্রাণবৈচিত্রে ভরা। বছরের বিভিন্ন সময় গারো আদিবাসীরা প্রায় ৩০ প্রকার বুনো সব্জি সংগ্রহ করে থাকে। বুনো সব্জির ভেষজ গুণ তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এগুলোর প্রাকৃতিকভাবে গুণগত মান ও স্বাদেও অতুলনীয়। গারোরা প্রাচীন কাল থেকে এসব বুনো সব্জিগুলো তাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় মেন্যূ হিসেবে রাখে। এছাড়াও এগুলো নানা অসুখ বিসুখে ভেষজ ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। বলতে গেলে, একটা সময় মধুপুর গড়াঞ্চলে বুনো সব্জি, আর ফলমুলে ভরপুর ছিল। কিন্ত  মধুপুরের সুবিশাল শালবনে উদ্ভিদ, বনজ প্রাণীর সঙ্গে অনেক বুনো সব্জিগুলোও আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।

আ.বিমা টাইমস গারোদের বুনো সব্জি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। আজকে প্রথম পর্বে থাকছে এই মৌসুমে পাওয়া যায় এমন সব্জির মধ্যে অন্যতম মিচেং বা সুমিচেং নিয়ে। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন আ.বিমা টাইমস এর টাঙ্গাইল প্রতিনিধি ওয়েলসন নকরেক।

মিচেং বা সুমিচেং মধুপুর বনে পাওয়া যায় এমন সব্জিগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। অধিকাংশ গারোই এই বুনো সব্জি পছন্দ করে। এর বাংলা নাম বাজনা, বান্দ্রা, কাটা হরিণা, তেজবল, বাদরঙ্গা। ইংরেজি নাম Prickly Tree, Cape Yellowwood. এর বৈজ্ঞানিক নাম Zanthoxylum Rhetsa.

 মিচেং বা বাজনা গাছের কান্ড, পাতা ও ফল

গাছের বিবরণ: মিচেং মধ্যম আকৃতির ডালপালা বিশিষ্ট, কাঁটাযুক্ত পাতাঝরা বৃক্ষ। গাছের উচ্চতা ১২-২০ মিটার এবং বেড় ৭৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। এদের গুড়ি কান্ড সরল, সোজা, গোলাকার এবং প্রধান কান্ডসহ ডালপালার গায়ে বেশ মোটা মজবুত তীক্ষ্ণ বড় বড় কাঁটা আছে। বাকল পুরু, মসৃণ, নরম ও হালকা হলদেটে বর্ণের।

মিচেং গাছের পাতা যৌগিক এবং ডালপালার আগায় গুচ্ছাকারে সজ্জিত। পত্রপলক লম্বায় ৩০-৭৫ সেন্টিমিটার এবং পত্রক সংখ্যা ১৬-২৫টি। বিপরীতমুখীভাবে সজ্জিত পত্রকগুলোলম্বায় ৬-১৪ সেন্টিমিটার ও চওড়ায় ১.৫-৩.০ সেন্টিমিটার এবং পাতার কিনারা সামান্য কাঁটাযুক্ত। পাতায় তীব্র ঝাঁঝালো সুঘ্রাণ রয়েছে। মার্চ থেকে এপ্রিল মাসে গাছে নতুন পাতা গজায়।

ভৌগলিক বিস্তৃতি : বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকা, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন ও পাপুয়ানিউগিনি। শ্রীলংকায় বানিজ্যিক ভিত্তিতে মিচেং গাছের চাষ করা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে প্রাপ্তিস্থান: চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সিলেটের মিশ্র চিরসবুজ বনে এবং ঢাকা, গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহের পাতাঝরা শালবনে মিচেং গাছ দেখা যায়। এই গাছ কাঁটাযুক্ত বলে ক্ষেতের বেড়ার খুটি হিসেবে ব্যবহার করার কারণে মধুপুর বনে এটি বিলুপ্ত হতে চলেছে। কারিতাস ময়মনসিংহ অঞ্চল ক্ষুদ্র পরিসরে গায়রা এই গাছসহ অন্যান্য বিলুপ্তপ্রায় বুনো সব্জি সংরক্ষণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন কারিতাস ময়মনসিংহ অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক অপূর্ব ম্রং।

খাদ্য হিসেবে এর ব্যবহার: গারো আদিবাসীরা এর কচি পাতা রান্না করে খায়। গারোরা সচরাচর মিচেং পাতা কলা পাতা দিয়ে হুথেপা বা গপ্পা করে খায়। সকল উপকরণ এক সাথে মেখে কলায় পাতায় মুড়িয়ে কয়লার আগুনে রান্না করার পদ্ধতিকে গারো ভাষায় হুথেপা বলে। তবে ভারতের গারোরা পাতিলে রান্না করেও খায়। এটিকে একক সব্জি অথবা পার্শ্ব সব্জি হিসেবে খেয়ে থাকে। একক সব্জি হিসেবে চ্যাপা শুটকি আর সোডা দিয়ে খারি রান্না করে। এছাড়াও এই পাতা মাছ, মাংস এবং অন্য সব্জির সাথে পার্শ্ব সব্জি হিসেবেও খারি রান্না করা যায়। পেট ফাঁপা অসুখের জন্য এই পাতার তরকারি খেলে উপকার পাওয়া যায় বলে গারো বয়স্ক গারোরা মনে করেন।