গারোদের বিশ্বাস ও বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্বের মিথ বা পুরাণ কাহিনীতে উল্লেখ রয়েছে, সৃষ্টির আদি অবস্থায় বিশ্বজগৎ বলতে কিছুই ছিল না। এই পৃথিবীর চারদিকে তখন নি:সীম কালো ঘোর–অন্ধকার ও অসীম জলরাশিতে পরিপূর্ণ ছিল। চারদিকে কেবল পানি আর পানি ছাড়া কোথাও আলো, ভূমি, প্রাণী বা গাছ পালার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এ অবস্থায় তাতারা–রাবুগা পৃথিবী সৃষ্টি করার কথা চিন্তা করলেন। তাঁর এই জাগ্রত ইচ্ছাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য তিনি তাঁর সহকারী দেবতা নস্তু–নপান্তুকে মনোনীত করলেন। নস্তু–নপান্তু একজন স্ত্রীলোকের বেশে তাঁর সহকর্মী ‘মাচি’র সহায়তায় পৃথিবী সৃষ্টির কাজে মনোনিবেশ করলেন।
সাংসারেক ধর্মের পূজা অর্চনার একাংশ
নস্তু–নপান্তু প্রথমে পানির ওপর বিছানো মাকড়সার জালে আশ্রয় নিলেন। তাতারা–রাবুগা পৃথিবী সৃষ্টি করার জন্য তাঁর হাতে এক মুঠো বালি দিয়েছিলেন। নস্তু–নপান্তু সেই এক মুঠো বালি দিয়ে প্রথমে পৃথিবীর আকার তৈরি করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোনোমতেই তিনি তা একত্র করতে পারলেন না। ওই কাজে তাঁকে সাহায্য করার জন্য কর্কটাকৃতির অতিকায় এক প্রাণীকে তিনি গভীর পানির তলদেশ থেকে কিছু কাদামাটি নিয়ে আসার জন্য প্রেরণ করলেন। কিন্তু পানির গভীরতা খুব বেশি থাকায় তার পক্ষে মাটি নিয়ে আসা সম্ভব হলো না। কাজেই সে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে এলো। সবশেষে নস্তু–নপান্তু ‘চিচিং–বারচিং’ নামক ছোট এক প্রাণীকে ওই কাজে নিযুক্ত করলেন। চিচিং–বারচিং গভীর পানির তলদেশে প্রবেশ করে কিছু কাদামাটি নিয়ে ফিরে এলো। আর সেই কাদামাটির সাহায্যে নস্তু–নপান্তু তখন এই পৃথিবী সৃষ্টি করলেন।
নস্তু–নপান্তু পৃথিবী সৃষ্টি করে এর নাম দিলেন ‘মানোপিল্টো’। পৃথিবীর বৃহদাকৃতির পাথর ‘মজার’ আর ছোট আকৃতির পাথর ‘ডিনজার’ ছাড়াও পৃথিবীর উপরিভাগ তখনো খুবই নরম ছিল। এর ওপর দিয়ে হাঁটা ছিল তখন অসম্ভব। এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করার জন্য নস্তু–নপান্তু তাতারা–রাবুগাকে অনুরোধ করলেন। তাতারা–রাবুগা নস্তু–নপান্তুর প্রার্থনা শুনে আকাশে সূর্য ও চন্দ্র দিলেন এবং মর্তে দিলেন বাতাস। সূর্যের আলো, চন্দ্রের কিরণ এবং মর্তের বাতাসে পৃথিবীর উপরিভাগ ধীরে ধীরে শক্ত ও কঠিন হয়ে উঠল।
তাতারা–রাবুগা পৃথিবীকে একটি অন্তর্বাস দান করলেন। তিনি মেঘের তৈরি একটি ‘পাগড়ি’ও তার মাথায় পরালেন। মাথায় চুলের শোভা বৃদ্ধির জন্য তিনি তার মাথায় ‘আমফাং’, ‘প্রাপ’ বৃক্ষের মূলের মতো তার মাথায় চুলও দান করলেন। প্রাণীদের মধ্যে তাতারা–রাবুগা প্রথমে লেজবিহীন বানর–জাতীয় একটি প্রাণীকে সৃষ্টি করেন। এই প্রাণীর কাজ ছিল তার বিকট আওয়াজ দ্বারা পৃথিবীকে সচল ও সজাগ করে রাখা। বিশ্ব প্রকৃতি যাতে ক্লান্তিতে অবসাদগ্রস্ত অবস্থায় ঝিমিয়ে না পড়ে তার যাবতীয় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সেই প্রাণীকে। এরপর তিনি হনুমান ও বাদামি রঙের বানর সৃষ্টি করেন। একইভাবে পরে অন্যান্য প্রাণী সৃষ্টি করেন তিনি।
শতবর্ষী খামাল দীনেশ নকরেক, ধরাতি
জলচর প্রাণীর মধ্যে প্রথমে তিনি একটি বৃহদাকৃতির কদাকার ব্যাঙকে সৃষ্টি করলেন। এই ব্যাঙের কাজ ছিল তার বিকট আওয়াজ দ্বারা অন্য জলচর প্রাণীর কাছে আকাশে মেঘের আগমন বার্তা ঘোষণা করা। ব্যাঙ সৃষ্টির পর তিনি গভীর জলের অন্য মাছগুলো সৃষ্টি করেন। পৃথিবী সৃষ্টির পর তাতারা–রাবুগা দেখতে পেলেন মাটির নিচে অনেক পানি আছে। কিন্তু পৃথিবীর উপরিভাগে কোথাও এক ফোঁটা পানি নেই। তখন তিনি পৃথিবীর বুকে নদী প্রবাহিত করলেন। কঠিন এই ধরার বুকে বারিধারা সিঞ্চনের নিমিত্ত তিনি আকাশে ‘নরে–চিরে–কিম্রে–বক্রে’ নাম্নি বৃষ্টিদেবীকে পাঠালেন। আকাশে বৃষ্টির আগমন বার্তা ঘোষণা করার জন্য তিনি ‘গোয়েরা’ (বজ্র)-কেও পাঠালেন।
তাতারা–রাবুগা পৃথিবীর সব কিছু সৃষ্টির অব্যবহিত পর সৃষ্টি করলেন ‘মানুষ’। আদি গারো ধর্মে বিশ্বাসীদের মতে, প্রথম মানব–মানবীর নাম হলো ‘শানী’ ও ‘মুনি’। তাতারা–রাবুগার আদেশে তাতারা–রাবুগা প্রাচ্যের ‘আমিতিং–আফিল্জাং’ নামক কোনো এক স্থানে গারোদের আদি পিতা–মাতা ও প্রথম নারী–পুরুষ এই শানী ও মুনিকে সৃষ্টি করেন। তাদের সন্তানদের নাম হলো ‘গানচেং’ আর ‘দুজং’। এই গানচেং এবং দুজংই হলো বর্তমান গারো জাতির পূর্বপুরুষ। বর্ণিত উপাখ্যানে সাংসারেক গারোদের নিম্নবর্ণিত দেবদেবীর অস্তিত্ব স্বীকৃত– পৃথিবী সৃষ্টির দেবতা তাতারা–রাবুগা বিশ্ব সৃষ্টিতে সাহায্যকারী দেবতা নস্তু–নপান্তু, নস্তু–নপান্তুর সহায়তাকারী মাচি; যিনি প্রকৃত প্রস্তাবে গারোদের প্রথম নারী দেবতা। নরে–চিরে–কিমরে–বকরে বৃষ্টির দেবতা, সালজং সূর্যের দেবতা এবং গোয়েরা বজ্রপাতের দেবতা। সাংসারেক গারোদের মধ্যে এসব দেবতাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কৃত্য বা Ritual আজ অবধি প্রচলিত।
বাংলাদেশসহ ভারতের গারো আদিবাসী অঞ্চলে কিছু সংখ্যক সংসারেক ধর্ম বিশ্বাসীদের দেখা মেলে। তবে বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে এ ধর্মের অনুসারীদের বেশি লক্ষ্য করা যায় এখনো। জনসংখ্যার তুলনায় বাংলাদেশের গারোরা এখন প্রায় শতভাগ খ্রীষ্টান। তথাপিও কিছু বাংলাদেশী সাংসারেক গারো তারা তাঁদের আদি শেকড় আকড়ে আছে। ঠিক এমনই এক টাঙ্গাইলের মধুপুর আবিমাঞ্চল। মধুপুর গড়ের কিছু গ্রামে এখনো সাংসারেক ধর্মের খামাল এবং মাদ্দক তারা তাঁদের ধর্মীয় কর্মকান্ড, পূজা পার্বণ যথারীতি তাদের যাপিত জীবনে বিশ্বাস করে এবং পালন করে।
সাংসারেক ধর্মের দেব-দেবীকে বলা হয় মিদ্দি বা মিতদে বা মিদ্দে। ধরাটি গ্রামের খামাল দীনেশ নকরেক, চুনিয়া গ্রামের খামাল জনিক নকরেক, সাইনামারী গ্রামের খামাল নরেশ মৃ প্রমুখগণ তাদের বর্ণনায় জানিয়েছেন সাংসারেক ধর্মে প্রায় ৭০০০ দেবতা, ৭০০ উপদেবতা (মিদ্দি হাজালস্নি, কাচ্চি রিচ্চাসনি) রয়েছে। এই ধর্মের লিখিত ধর্মগ্রন্থ নেই বলে এই সব দেবতাদের নাম জানা বা সংগ্রহ করার কাজটি অত্যন্ত কঠিন। কেননা, খামালরাও শুধুমাত্র উল্লেখযোগ্য কিছু সংখ্যক দেবতাদের উদ্দেশে পূজা দিয়ে থাকেন এবং তাঁদের নামই মনে রাখতে পারেন।
অনেক বিদেশি লেখক, গবেষক বিশেষভাবে ভারতের গারো লেখকদের তথ্য অনুযায়ী গারো সাংমসারেকদের বিশ্বাস অনুসারে, সাংসারেকদের সকল মিদ্দি বা দেবতাদের শক্তিধর। বিভিন্ন দেবতাদের বিভিন্ন ক্ষমতা রয়েছে। এই দেবতারা সবসময় মানুষের কল্যাণ করে থাকেন। তবে, মানুষ তাদেরকে (দেবতাদেরকে) ভুলে গেলে বা অমান্য করলে দেবদেবীরা মানুষকে শাস্তি দিয়ে থাকেন; আর তখনই দেব-দেবীর উদ্দেশে আমুয়া (পূজা) দিতে (বাধ্য) হয়। এ ছাড়াও মানুষের অকল্যাণকারক বা অপদেবতাদের বিভিন্ন নাম রয়েছে।
গারো ভাষার ‘খামাল’ শব্দের বাংলা অর্থ পুরোহিত অর্থাৎ যাঁরা সাংসারেক মূল পূজাগুলো পরিচালনা ও সম্পদন করে থাকেন। আর গারো শব্দ ‘মাদ্দক’ এর বাংলা অর্থ হলো; যিনি পূজার বেদীতে খামালকে পূর্ণ সহযোগিতা এবং সাংসারেক ধর্মের ছোটখাটো পূজাদি সম্পাদন করে থাকেন। মধুপুর গড় বা আবিমাঞ্চলে কিছু গ্রামের জীবিত খামাল এবং মাদ্দকদের নাম–
মধুপুর গড়াঞ্চলে বিভিন্ন গ্রামের সাংসারেক খামাল ও মাদ্দক –
খামাল জনিক নকরেক, চুনিয়া
খামাল দীনেশ নকরেক, ধরাতি
খামাল নরেশ মৃ, সাইনামারী
খামাল ক্লেমেন্ট নকরেক, কাকরাগুনি
খামাল সনেন নকরেক, বন্দরিয়া
খামাল নেগেন খকসি, বেদুরিয়া
খামাল তমেত সাংমা, উত্তর জাঙ্গালিয়া
সাংসারেক মাদ্দক (সহ-পুরোহিত)–
মাদ্দক বাজিন্দ্র ম্রং, নয়নপুর
মাদ্দক নকু নকরেক, সাইনামারী
মাদ্দক লেবেন মৃ (সাধু), পীরগাছা
মাদ্দক মিসিন দালবত (দয়াল) ,পীরগাছা
মাদ্দক নেশন নকরেক, পীরগাছা
মাদ্দক শৈলেন নকরেক, নয়নপুর
মাদ্দক সিলবেশ নকরেক, ধরাতি
মাদ্দক মিজেন নকরেক, হাগুড়াকুড়ি
মাদ্দক তিনেশ দালবত, বেদুরিয়া ।
শতবর্ষী খামাল জনিক নকরেক, চুনিয়া
গারোদের সাংসারেক সৃষ্টিতত্ত্ব প্রায় অন্যান্য প্রধান প্রধান ধর্মবিশ্বাসের অনুরূপ। বিশেষ করে পবিত্র বাইবেলে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্বের সঙ্গে ব্যাপক সাদৃশ্য বিদ্যমান। তাদের বিশ্বাস আদিতে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জলময় ও ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। পরবর্তীকালে প্রধান দেবতা তাতারারাবুগা তাঁর সহচর নস্তু-নপান্তু ও অন্যান্য দেব-দেবীর সহায়তায় পৃথিবী, আকাশমণ্ডল, গ্রহ-নক্ষত্র, সাগররাজি, পর্বতমালা, নানা জীব-জন্তু, গাছপালা প্রভৃতি সৃষ্টি করেন। তাতারা-রাবুগা ছাড়াও গারোদের উপাস্য আরও অনেক দেব-দেবী রয়েছে। এইসব দেব-দেবীর কারো কারো দায়িত্ব মানুষকে বিষয় সম্পদে সৌভাগ্যশালী করা আবার কারো কারো দয়িত্ব মানুষকে নানাবিধ রোগ-ব্যাধি প্রদানের মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করা। মূলত, শান্তি, নিরাপত্তা, নীরোগ স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের আকাঙ্ক্ষায়ই মানুষ দেবতাকে আবিষ্কার করেছে। তাই মানুষ হয়তো জীবনের একেকটা দায়িত্ব একেক দেবতাকে অর্পণ করে নিশ্চিত হতে চেয়েছে। গারো জনগোষ্ঠীর মধ্যেও এই প্রবণতা লক্ষণীয়। ফলে উল্লিখিত দেবতা ছাড়া জীবনের অন্যান্য বিষয় ও দিকের নিয়ন্তারূপে আরো অসংখ্য দেবদেবীকে শনাক্ত করেছে এবং পূজা করে থাকে।
আপাত দৃষ্টিতে এসব বিশ্বাস প্রায়ই যুক্তিহীন, আবার কোথাও বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তিযুক্ত। গারোরা সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বরাবর বিশ্বাস করে এসেছে। তিনি যে এই পৃথিবীর সবকিছুর স্রষ্টা এ বিশ্বাস গারোদের মধ্যে ছিল। গারোরা একই সঙ্গে মানবদেহে আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী এবং সেই আত্মা যে অবিনশ্বর এটাও তারা বিশ্বাস করে। তারাও হিন্দুদের মতো জন্মান্তর বাদে বিশ্বাসী। গারোদের প্রথাগত বিশ্বাস ও সংস্কার সর্বস্ব একটি অনানুষ্ঠানিক কৃষিভিত্তিক ধর্মোৎসব রয়েছে। জমির উর্বরতা বৃদ্ধি, ফসল সংরক্ষণ, রোগশোক, মহামারী, ভূত-প্রেত-রাক্ষস ইত্যাদি অদৃশ্য অপশক্তির অমঙ্গল থেকে বাঁচার জন্য তারা বারো মাসে তেরো কিংবা ততোধিক ব্রত ও পর্ব-পার্বণ পালন করে।
আদি গারো এবং বর্তমান সাংসারেকদের বিশ্বাস অনুসারে একেক দেবতার মর্জি, বাসনা একেক রূপ। তাঁদের খুশি করার রীতিও ভিন্ন ভিন্ন। ভিন্ন ভিন্ন তাঁদের উপাচার, নৈবেদ্য, মন্ত্র এবং পূজার লগ্ন। কৃত্যের বাঁধা ছকে আবদ্ধ জীবন তাই কৃত্য সর্বস্ব। তথ্য (প্রকাশিতব্য গ্রন্থ): গারো সংস্কৃতির মাধুর্য
লুই সাংমা, প্যারিস, ফ্রান্স
ওয়েভ ডেভেলপার, ব্লগার, আন্তর্জাতিক ফ্রিল্যান্সার এবং সাংস্কৃতিক কর্মী।