দেশের বাজারে ভোজ্য তেলে আগুন লেগেছে। তেলের বিকল্প খুঁজতে গিয়ে কারোর পকেটে কিংবা মাথায় হাত পড়ছে, পড়ছে কি! সবার প্রশ্ন একটাই- তেলের বিকল্প উপায় কি হতে পারে! আপনি যদি গারো আদিবাসী কিংবা অন্য কোন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর হন তাহলে নো চিন্তা ডু ফুর্তি। ভোজ্য তেলে আগুন, তুড়ি মেরে উডিয়ে দাও।
প্রাচীনকাল থেকে ঐতিহ্যগতভাবে আদিবাসীরা তেলের বিকল্প ব্যবহার জানে। তবে যুগের দোলাচলে শহরগামী আদিবাসীদের তেল ঝামেলায় জীবন জীবিকা কিছুটা বেকায়দায় ফেলে দিতে পারে। এহেন আমি তাদের কথা ভাবছি না। কারণ স্বল্প আয়ের মানুষ বেশিরভাগ গ্রামেই থাকে। শহুরে খাবারে তারা খুব বেশি অভ্যস্ত নয়।
তেলের বিকল্প খাবারে আপনার যে লাভ হতে পারে
আমাদের দৈনন্দিন খাবারে অভ্যাসগত পরিবর্তনের কারনে সবাইকে কমবেশি তেলের ঝামেলাটি ভোগাবে এটি যেমন সত্য, অন্য দিকে এর বিকল্প যদি সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারেন তাহলে আপনি আর্থিক সাশ্রয়, এমন কি স্বাস্থ্যগত ঝুকি থেকে মুক্তিও সহজে পেতে পারেন।
তেলের বিকল্প উপায় তৈরি আপনার খাবারের পুষ্টিগুণ নষ্ট করে তা কিন্ত নয়; বরং কিছু কিছু তেলবিহীন খাবার আপনার স্বাদ এবং পুষ্টিগুণ অক্ষুন্ন রাখে। তেলহীন খাবার দেহের কলেস্টরলকে নিয়ন্ত্রণ করে।
খাবারে কোলেস্টরল কি ?
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে কলেস্টরল কি, কোলেস্টেরল এক ধরনের চর্বিজাতীয়, তৈলাক্ত স্টেরয়েড যা কোষের ঝিল্লি বা (সেল মেমব্রেনে)-এ পাওয়া যায় এবং যা সব প্রাণীর রক্তে পরিবাহিত হয়। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সেল মেমব্রেনের এটি একটি অত্যাবশ্যক উপাদান।
মানুষের শরীরে কোলেস্টরল এর প্রয়োজনীয়তা একেবারে নেই তা কিন্ত নয়। শরীরের বিভিন্ন জৈবিক কার্য়প্রণালির জন্য উপযুক্ত পরিমাণে কোলেস্টরল প্রয়োজন। যেমন Estrogen, Progesterone, Testosterone, Cortisol এবং Aldosterone এ জাতীয় হরমোন উৎপাদনের জন্য এটি অত্যাবশক।
যা হোক বলছিলাম খাবারে তেলের বিকল্প কি হতে পারে- আসলে খাবারের গুণ ও স্বাদ নির্ভর করে এতে ব্যবহার করা মসলার ওপরে। এক্ষেত্রে তেলের তেমন একটা ভূমিকা নেই বললেই চলে। থাকলেও খুবই সামান্য। তাই জেনে নিতে পারেন গারো খাবারে তেল ছাড়া রান্না বান্নার মেন্যু কি এবং এর উপায় হতে পারে।
তেলের বিকল্প রান্নার মেন্যু কি কি হতে পারে
গারোদের অনেক খাবার আছে যেগুলো তৈরি করতে তেলের প্রয়োজন হয় না। সেসব খাবার রাখতে পারেন প্রতিদিনের খাবারের তালিকায়। সেইসঙ্গে যেসব খাবার সাধারণত তেল দিয়ে রান্না করা হয়, সেগুলোও তেল ছাড়া রান্না করে খেতে পারেন।
গারোদের প্রধান খাদ্য ভাত। আগেকার দিনে গারোরা ভাতের বিকল্প হিসেবে আবাদি এবং বন্যআলুর প্রায় ১৭টি জাতের (এর বেশিও হতে পারে) আলু সিদ্ধ করে অথবা আগুনে পুড়ে খেতো। ভাত এবং আলু সেদ্ধ ছাড়াও এরা কলাপাতায় মুড়িয়ে কাপ্পা বা গপ্পা পদ্ধতিতে এবং বাঁশের চুঙ্গাতে ভরে সেগুলো আগুনের কয়লার তাপে সেদ্ধ করা (ব্রেঙা) পদ্ধতিতে খেতে অভ্যস্ত। বিভিন্ন সবজি যেমন বেগুন, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, বরবটি, ঝিংগা, করলা, চিচিংগা, কচু চাষাবাদ এবং খাবারের সাথে আদিকাল হতে অভ্যস্ত হলেও অন্যান্য জাতির মতো গারোদের কাছেও মাছ মাংস খুবই প্রিয়। মাছ মাংস ছাড়া এদের মধ্যে অতিথি আপ্যায়ন হয় না। মাংসের মধ্যে শূকর, কচ্ছপ এবং কুঁচে এবং অন্যান্য বন্যপ্রাণির মাংসেও গারোরা অভ্যাস্ত। শুঁটকি মাছ (নাখাম) গারোদের কাছে প্রিয় খাদ্য। বর্ষাকালের জন্য গারোরা সবসময় মাছ এবং মাংসের শুটকি মজুদ রাখে। শীতের প্রারম্ভে পাহাড়ি নদী হতে যে সমস্ত মাছ তারা ধরে সেসব মাছ দিয়ে নিজেরাই নাখাম তৈরি করে সারা বছরের জন্য মজুদ রাখে। পুঁটি মাছের নাখামই গারোদের সবচেয়ে প্রিয় খাবার। শুঁটকী মাছের রান্না করা তরকারিকে গারো ভাষায় বলা হয় খারিজাবা। খারি হচ্ছে, প্রাকৃতিক ক্ষার বা সোডা; যা কলাপাতা বা খোল, বটগাছ, সরিষার গাছ, তিলের গাছ ইত্যাদি পুড়িয়ে এর ছাইগুলো ভিজিয়ে গেংরেং (বাঁশের বেতি দিয়ে তৈরী ছাঁকনি) দিয়ে ছেঁকে এর পানিটাকে ক্ষার হিসাবে তরকারিতে ব্যবহার করা হয়। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে খারিজাবা রান্নায় তৈল, হলুদ, মসলা, জাতীয় কোন কিছুই দিতে হয় না, তবে তৈল তরকারি রান্নার চেয়ে কিছু বেশি পরিমাণে কাঁচামরিচ ব্যবহার করতে হয়। আগুনে পোড়ানো বা ঝলসানো মাছ বা মাংসের ভর্তা তৈরীতেও গারোরা অত্যন্ত পটু এবং স্বাদেও তুলনাহীন।
গারো ঐতিহ্যবাহী খাবারের প্রতীকী ছবি
অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মতোন গারোদের রান্না করার প্রত্যেকটা রন্ধনপ্রণালির নাম রয়েছে। এলাকাভেদে আরও কোন রন্ধনপ্রণালী এবং নাম থাকতে পারে। এখানে আমার পরিচিত গারো খাবারের মেন্যুর নাম দেয়া গেল। তাহলে জেনে নিন তেল ছাড়া গারো রান্নার মেন্যুগুলো কি কি হতে পারে- ব্রেঙা, গপবা, খাপ্পা, থেপবা/হুথেবা, খারি গেকগা/খারি রুদিতদা, ফুরাখারি/ফুরারুদিদ্দা, সং.থাদা, বে.এনফুরা, বিখাজাবা (মধুপুইরা), না.খাম মি.চি, মেন্দাজাবা, সো.আ/সো.খাংক্রতা, জা.ল্লিকথেকগা, সং.গ্রবা, নঙা/নংওয়েকা বা ভর্তা, থানিংজাবা/থারুজাবা,
এলদিজাবা, বিবুকজাবা, না.খিজাবা, খি.ওয়েকজাবা, জ.অয়া/জ.খ্রামা, জ.রেরেপবা ও জ.স্রাগা ইত্যাদি।
এবার একটি রান্নার রিসিপি উদাহরণ হিসেবে দিলে মন্দ হয় না, যেমন না.খাম বিচ্চি বা না.খাম মি.চি-
অতি সাধারণ এবং সহজতম এ নাখাম মিচি রান্নার পদ্ধতি ও ঝামেলাহীণ। কোল্ড ড্রিংকের বিকল্প, হট ড্রিংকস অথবা বলা যায়, আদা, তুলসিপাতার স্যুপ। এই পদ্ধতিতেও তেল, হলুদ, গরম মসলা জাতীয় বাড়তি খরচ দূরে থাকুক। প্রয়োজনমতো হাঁড়িতে পানি (ঝোল) আর পরিমাণ মতো নাখাম, লবন, কাঁচা মরিচ, আদা, ফানেট (সাদা তুলসিপাতা) দিয়ে চড়িয়ে দিন। সেদ্ধ হয়ে গেলে আগুনের আঁচ কমিয়ে নিন এবং আস্তে আস্তে খারিচি বা খাবার সোডা দিয়ে নাড়তে থাকুন। সোডা দেওয়ার সময় খেয়াল রাখবেন যেন তরকারির পানি বা ঝোল দেনায় পরিণত হয়ে বাইরে পড়ে না যায়। ইচ্ছে হলে এই তরকারিতে কিছু কচি মুরগীর মাংস অথবা ছোট মাছ (বড় মাছ হলে ছোট ছোট টুকরো করে), অথবা মাছের শুটকী, নোনা ইলিশ দিতে পারেন। হাতের নাগালে ফানেত বা সাদা তুলসিপাতা না থাকলে কিছু হি.চিং (আদা)- এর পাতা দিয়ে নিন।
গারোদের অনেক খাবারে তেলের ব্যবহার নেই বললেই চলে। আমরা চাইলে সহজে এই আগুন সমেত তেল সংগ্রহের বিরম্বনা থেকে মুক্তি পেতে পারি। এছাড়াও আরও অনেক অনাকাঙ্খিত রোগ শোক থেকে নিজেকে এবং গোটা পরিবারকে মুক্ত রাখতে পারি।
মোদ্দা কথা হলো, উপায় না থাকলেও একটা উপায় খুঁজে নিতে হয়। তেলের বিকল্প নেই যে তা নয়; গারোদের রান্নায় বিকল্প ব্যবস্থাতো রয়েছেই। ফলে তেলের আকাল বা দুর্দিনে গারোদের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী খাবারের দিকে আমরা আরও বেশি মনোযোগ দিতে পারি।
লুই সাংমা, সাংস্কৃতিক কর্মী