আধুনিক বিশ্বায়নে সকল দেশে সকল জাতির জীবন প্রণালী এবং তাদের খাদ্যাভাসেও প্রত্যাশার চাইতেও বেশি পরিবর্তন এসেছে। গারোদের খাবার, রুচিবোধের পরিবর্তন হলেও কিছু কিছু গারোদের ঐতিহ্যবাহী খাবার, খাবারের সঙ্গে তরকারি, খাবার এখনো মনভোলায়, কাছে টানে, খাবারের নাম শুনলে জিভে জল টলোমলো করে।

গারোদের প্রধান খাদ্য ভাতের সঙ্গে যে তরকারির মেন্যু থাকে সেগুলো দেখতেও যেমন খুবই সাধারণ, তেমনি রান্না, বা রন্ধন প্রনালীগুলোও একেবারে তেলহীন, মোখরোচক মসলা নেই বললেই চলে। রান্নার পুরো ব্যাপারটিই প্রাকৃতিক আর হাতের ম্যাজিক মনে হবে। তবে এর স্বাদ এবং খাদ্য মানও অটুট থাকে। সেসব তরকারী হতে পারে পুরো রান্না, সিদ্ধ অথবা আগুনে পুড়ে। রান্না ও সেদ্ধ ছাড়াও কলাপাতায় মুড়িয়ে কাপ্পা বা গপ্পা পদ্ধতিতে এবং বাঁশের চুঙ্গাতে ভরে সেগুলো আগুনের কয়লার তাপে সেদ্ধ করা (ব্রেঙা) পদ্ধতি। বিভিন্ন সবজি রান্না যেমন বেগুন, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, বরবটি, ঝিংগা, করলা, চিচিংগা, কচু ইত্যাদির রান্নার নিজস্বতা রয়েছে। বিভিন্ন মাংস তরকারি রান্নার মধ্যেও যেমন শূকর, কচ্ছপ, কুঁচে এবং অন্যান্য প্রাণির মাংসতেও বাহারি পদের রান্নার পদ্ধতিও ভিন্নতা থাকে।

এছাড়াও মাছ, শুঁটকি মাছ (নাখাম) গারোদের কাছে প্রিয় একটি খাদ্য। যার ফলে একটা সময় গারোরা মাছ দিয়ে নিজেরাই নাখাম তৈরি করে সারা বছর খেতো। শুঁটকী মাছের রান্না করা তরকারিকে গারো ভাষায় বলা হয় খারিজাবা। খারি হচ্ছে, প্রাকৃতিক ক্ষার বা সোডা; যা কলাপাতা বা খোল, বটগাছ, সরিষার গাছ, তিলের গাছ ইত্যাদি পুড়িয়ে এর ছাইগুলো ভিজিয়ে গেংরেং (বাঁশের বেতি দিয়ে তৈরী ছাঁকনি) দিয়ে ছেঁকে এর পানিটাকে ক্ষার হিসাবে তরকারিতে ব্যবহার করা হয়। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে খারিজাবা রান্নায় তৈল, হলুদ, মসলা, জাতীয় কোন কিছুই দিতে হয় না, তবে তৈল তরকারি রান্নার চেয়ে কিছু বেশি পরিমাণে কাঁচা মরিচ ব্যবহার করতে হয়। আগুনে পোড়ানো বা ঝলসানো মাছ বা মাংসের ভর্তা তৈরীতেও গারোরা অত্যন্ত পটু এবং স্বাদেও তুলনাহীন।

গারোদের রান্না করার প্রত্যেকটা রন্ধন প্রণালির আলাদা নাম রয়েছে। সেগুলো এলাকা বা অঞ্চলভেদে আরও কোন রন্ধনপ্রণালী এবং নাম থাকতে পারে। এখানে কিছু সুপরিচিত রন্ধনপ্রণালী, এবং জনপ্রিয় কিছু খাবার, তরকারির নামগুলো সংক্ষিপ্তাকারে দেওয়া হলো; যার নাম শুনলেও সুস্বাদু আর গন্ধেও আপনাকে কাছে টানবে, যেমন-

  • রিদ্দা (সেদ্ধ) গারোদের অনেক প্রকার রন্ধনপ্রাণালির মধ্যে এই সেদ্ধপ্রণালি অন্যতম। সর্বজন পরিচিত এবং জনপ্রিয় ভাত সেদ্ধ। এর পরেই গারোদের ভাতের বিকল্প খাবার হিসাবে থামা থাবলচু, থাজং, থামিলাং, থাদিক, থাথুরাক, থাদাম্বু/থাদাম্বং, হামাকগ্রেং, থামাচি, থাবুরত ইত্যাদি; এবং বন্য আলুর মধ্যে স্থেং, আমফেং, থাজা, থাগিচ্চাক, থাস্থেং, চংচঙ্গি ইত্যাদি পরিমাণমত সামান্য লবন দিয়ে সেদ্ধ করে খেতে হয়। একই পদ্ধতিতে ফলের মধ্যে বিল্লিক (বরবটি জাতীয় এক প্রকার কলাই/ডাল), মেন্দু (অড়হর) এবং কাঁচা কাঠাল ইত্যাদি সেদ্ধ খাবার খুবই সুস্বাদু।
  • মিমিল/মিসিরি রিতদা এই পদ্ধতিকে আসলে ইংরেজিতে স্টিকি রাইস বলে। একটি মাটির হাঁড়ির তলায় কয়েকটি ছোট ছোট ফুটো করে তাতে মিমিদ্দিম (বিন্নি চাল) এবং মিসিরি (কাউন) ইত্যাদি গরম পানির ভাপ দিয়ে মিমিল সেদ্ধ করতে হয়। মিমিল সেদ্ধ যেকোন মাংসভোনা, অথবা শুটকী মাছের খারিজাবা বা নাকাম ভর্তা দিয়ে খেতে অত্যন্ত চমৎকার এবং গারোদের জনপ্রিয় খাবার।
  • ওয়াসিং মিমিদ্দিম রিতদা (বাঁশের চুঙ্গায় ভাত সেদ্ধ) বাঁশের চুঙ্গায় ভাত সেদ্ধ করার নাম ওয়াসিং’ও মিমিদ্দিম রিতদা। চামড়া পাতলা বাঁশ কেটে চুঙ্গা বানিয়ে তাতে ভিজিয়ে রাখা চাল ভরে পরিমাণমত পানি দিয়ে চুঙ্গার ‘মুখটাকে কলাপাতা দিয়ে বন্ধ করে রান্নার পদ্ধতি হলো ওয়াসিং মিমিদ্দিম ভাত। এ খাবারের স্বাদ এবং সুগন্ধ অতুলনীয়। ফলে যেকোন মাংসভোনা, শুটকী ভর্তা দিয়ে খেলে স্বাদে ভরপুর।
  • ব্রেঙা চুঙ্গা পদ্ধতিতে মাছ, মাংস, শুঁটকী অথবা যেকোন সব্জি রান্নার নাম ব্রেঙা। উপাদানগুলো হলো পরিমাণমত লবন, কাঁচামরিচ, পেয়াজ, আদা মেখে একইরকম চুঙ্গায় ভরে কলা বা যেকোন সব্জির পাতা দিয়ে চুঙ্গার মুখটি বন্ধ করে আগুনে পুড়ে রান্না তরকারি। এই রান্নায় তেল মসলার প্রয়োজন নেই। এমন ব্রেঙা তরকারির স্বাদ অপূর্ব।
  • গপবা কলাপাতায় মুড়িয়ে মাছ, মাংস, শুঁটকী অথবা সব্জি রান্নার নাম গপবা। একেই বলে মসলাবিহীন রান্না। অর্থাৎ একেবারে তেল, হলুদ, গরম মসলা ছাড়া রান্না। বিছাকলার কচিপাতা আগুনে অথবা রোদের তাপে কিছুক্ষণ রেখে পাতাগুলো নরম হয়ে গেলে পাতাগুলো চতুর্ভুজ আকারে ছিঁড়ে বা গোলাকার করে রান্নার উপাদানগুলো পাতা দিয়ে মুড়িয়ে, মুখ বেঁধে রান্না পদ্ধতি। রান্নার উপাদান মাংস বা সব্জি হতে পারে। রান্নার উপাদানগুলোতে পরিমাণমত লবন, কাঁচামরিচ, পেয়াজ একসাথে মাখার পর অল্প পানি দিয়ে পাতাগুলো চারকোণায় একসাথে চেপে মুখটা ভালো করে মুড়িয়ে বেঁধে দিতে হবে। এরপর মোড়ানো উপাদানটি হালকা কয়লার আগুনে রেখে দিলে, দেখবেন অল্প আগুনের তাপেই খাবার সেদ্ধ হয়ে যাবে। এই পদ্ধতিতে বন্য বা অনাবাদি সবজি সামগলদাক, খুমকা, আপ্পলকা, সেরেংখি, সুমুচ্চেং, দখুমি ইত্যাদি রান্না করতে চাইলে আপনাকে চেপা শুঁটকী অথবা কাঁচা ছোটমাছ এবং খারিচি বা সোডা দিয়ে রান্নার পদ্ধতি তারকারির স্বাদকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
  • খাপ্পা তেল, হলুদ, মসলা ছাড়া হাঁড়ি বা কড়াইয়ে মাছ, মাংস, শুঁটকী রান্নার নাম খাপ্পা। রান্নার উপাদানগুলোতে পরিমাণ মতোন লবন, ঝাল (কাঁচামরিচ) স্বাভাবিক নিয়মে তৈল তরকারির চেয়ে একটু বেশি দিয়ে পেয়াজ মাংসের পরিমানের প্রায় অর্ধেক কুচি করে কেটে সবগুলো একসাথে মেখে হাঁড়ি বা কড়াইয়ে চুলায় বসিয়ে রান্নার পদ্ধতিই হলো খাপ্পা। এ পদ্ধতিতে ছোট মাছ অথবা বড় মাছ হলে মাছের টুকরো ছোট করে কেটে পরিমাণ মতোন পানি দিয়ে ভালো ঢাকনা দিয়ে ভালো করে ঢেকে রান্না করতে হবে। ঝোল রাখা যাবে না। মসলা ছাড়া খাপ্পা তরকারী গারোদের খুবই প্রিয় একটি তরকারী।
  • থেপবা বা হুথেবা এই থেপবা বা হুথেবা রান্নার উপাদানের পরিমাণ কম দিয়ে এই পদ্ধতিতে রান্না করা হয়ে থাকে। নাখাম (চেপা শুঁটকী), সামগলদাক, স্থেং খাম্বি, দখুমি, সুমুচেং ইত্যাদি যেকোন সব্জির সাথে পরিমাণমত লবন, কাঁচামরিচ দিয়ে খারিচি বা খাবার সোডা দিয়ে অল্প কলাপাতায় (মি স্রমা স্টাইলে) মুড়িয়ে ভাত রান্নার করার সময় ভাতের পানি শুকিয়ে যাওয়ার আগেই গরম ভাতের উপরে বসিয়ে দিতে হয়। সেদ্ধ হয়ে গেলে সেগুলো বাটিতে নিয়ে ভালো করে মেখে নিন। একই পদ্ধতিতে কয়েক প্রকারের টকপাতা যেমন- মেন্দা বা গালদা, সেরেংকি, রাজাগুরু ইত্যাদি রান্না করতে চাইলে পরিমাণমত লবন, কাঁচামরিচ এবং পেঁয়াজ দিয়ে নিন। টকসব্জিগুলোর প্রকৃত স্বাদ অর্থাৎ টক হিসাবে খেতে চাইলে তরকারীতে ভুলেও খারিচি বা খাবার সোডা দিবেন না। খারিচি বা সোডার পরিবর্তে একটু বেশি করে পেঁয়াজের কুঁচি দিন রান্না করলে থেপবা আরও স্বাদেও অতুলনীয়।
  • ফুরাখারি বা ফুরারুদিদ্দা নাখাম (চেপা শুটকী) এবং নাথকগ্রান (শুটকী)-এর চালের গুঁড়া রান্না করার করা নাম ফুরাখারি। চালের গুঁড়ার সাথে যেকোন ডাল মিশিয়ে দিলে এর স্বাদ আরও ভালো হয়। প্রয়োজনমত ডাল, তরকারির জন্য পানি এবং এরপর পরিমাণমত লবন, কাঁচামরিচ কেটে দিয়ে কিছুক্ষণ পর গরম পানিতে নাখাম এবং নাথকগ্রান ছেড়ে দিন। শুঁটকী সেদ্ধ হয়ে গেলে হয়ে গেলে ফাসিম, খাকখু, বলব্রেত, দখুমি ইত্যাদির যেকোন পাতা কুচিকুচি করে কেটে দিয়ে ভালো করে নাড়তে হবে। ঐ পাতাগুলোর কোনটিই না পেলে লাউ, চালকুমড়া অথবা মিষ্টিকুমড়ার পাতা বিকল্প হিসেবে দিতে পারেন। শেষে খারিচি বা খাবার সোডা দিয়ে ভালো করে নেড়ে; টেস্ট করে নিন সব ঠিক আছে কিনা। তারপর, ফুটন্ত পানিতে চালের গুঁড়া ছেড়ে নাড়তে থাকুন; যতক্ষণনা ফুরা অর্থাৎ মিশ্রিত চাউলের গুঁড়ার পানি ঘন না হয়ে আসে।
  • সং.থাদা  যেকোন মাংস ঝোল ছাড়া (বা হালকা ঝোল রেখে) রান্নার পদ্ধতির নাম সং.থাদা। বাংলায় এই পদ্ধতিকে মাংসের ভুনা তরকারি বলা যেতে পারে। এ রান্নায় তৈল দিয়ে অথবা খারিচি বা খাবার সোডা দিয়ে- দুইভাবেই রান্না করা হয়। তৈল তরকারি পদ্ধতিতে রান্না করে ঝোল না রাখলেই চলবে। আর খারি পদ্ধতিটা ঐ খাপ্পা তরকারি রান্নার পদ্ধতির মতোন প্রায়। তবে খাপ্পা পদ্ধতির চেয়ে হাঁড়ি বা কড়াইয়ে সামান্য বেশি পানি দিয়ে মাংস পরিমাণমত লবন, কাঁচামরিচ, আদা দিয়ে চুলায় বসিয়ে দিয়ে রান্না করা হয়। মাংস নরম হয়ে গেলে ফাসিম, খাকখু, বলব্রেত, দখুমি ইত্যাদির যেকোন পাতা পরিমাণমত কুচিকুচি করে কেটে দিয়ে ভালো করে নেড়ে দিন। ঐ পাতাগুলোর কোনটিই না পেলে লাউ, চালকুমড়া অথবা মিষ্টিকুমড়ার পাতাও দিতে পারেন। খারিচি বা সোডা দেওয়ার সময় তরকারি নাড়াচাড়া বেশি করুন। একদম খাপ্পার মতো শুকনো তরকারি পছন্দ না হলে সামান্য ঝোল রেখে নামিয়ে পরিবেশন করুন।
  • বে.এনফুরা সং.থাদা আর বে.এনফুরার রান্না পদ্ধতি প্রায় একই। গারো ভাষায় বে.এন মানে হচ্ছে মাংস। অর্থাৎ এই রান্নাতে মাংস কমন। এ রান্নাতেও তেল, হলুদ, মসলার প্রয়োজন নাই। তেল তরকারির পরিমাণমত, এরপর লবন, কাঁচামরিচ, আদা দিয়ে মাংসগুলো কষে নিতে হবে। মাংসগুলো কষানো হয়ে গেলে পরিমাণমত সং.থাদা পদ্ধতির চেয়ে বেশি পরিমাণে গরম পানি দিতে হবে, কারণ এই পদ্ধতির রান্নায় আপনাকে চালের গুঁড়া মিশাতে হবে। যেহেতু হলুদ দেওয়া হচ্ছে না, তাই তরকারি রঙিন করতে এবং স্বাদ বাড়াতে ফাসিম, খাকখু, বলব্রেত, দখুমি, লাউ, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়ার পাতা ইত্যাদির যেকোন পাতা কুচিকুচি করে কেটে দিতে হবে। এরপর খারিচি অথবা খাবার সোডা দিয়ে নেড়ে দিন। তরকারির পানি শুকিয়ে গেলে খাবারের জন্য পরিবেশন করতে পারেন। একই পদ্ধতিতে কাঁচা মাছ অথবা শুঁটকী মাছ, শুঁটকী মাংস, শামুক ইত্যাদি দিয়ে ফুরাজাবা রান্না তরকারি অত্যন্ত সুস্বাদু।
  • বিখাসাম বা বিখাজাবা (মধুপুইরা) বিখা মানে হচ্ছে কলিজ্বা। বিখাজাবা শূকরের মাংস ছাড়া আর কোন কিছুতে হয় না। এ তরকারি মধুপুরের মানুষের কাছে অত্যন্ত প্রিয় আর জনসমাদ্রিত। এই বিশেষ তরকারি ছাড়া মধুপুর বা আবিমাঞ্চলের কোন দাওয়াত নাকি উপাদেয় হয় না। তাই এটাকে মধুপুইরা তরকারিও বলা হয়। বিখাজাবা পদ্ধতিতে রান্না করতে হলে শূকর কাটার সময় শূকরের রক্ত রেখে দিতে হবে। এরপর আতপ চালের গুঁড়া, ফাসিমপাতা (অথবা খাকখু, বলব্রেত ইত্যাদির যে কোন একটি) কুচি করে কেটে বা গুড়িয়ে রাখতে হবে। মাংস এবং কলিজ্বা সমপরিমাণে নিয়ে মাংসগুলো ভালো করে ধুয়ে  রান্নার পাত্রে পরিমাণমত লবন, কাঁচা মরিচ দিয়ে কলিজ্বা এবং মাংসগুলো ঝাল দিতে থাকুন। হাঁড়ি বা কড়াইয়ের পানি গরম হয়ে গেলে ফাসিমপাতা (অথবা খাকখু, বলব্রেত ইত্যাদি) ঢেঁকিতে ছেঁচে অথবা পাটায় বেটে অথবা কুচিকুচি করে কেটে দিয়ে ভালো করে নেড়ে মাংসগুলো কষে নিন। এবার খারিচি অথবা সোডার পাত্রটি নিয়ে পরিমাণ মতো ঢেলে দিয়ে মাংসগুলো মাখামাখা করে নেড়ে দিন। কষানো হয়ে গেলে ওয়াক হাঞ্চি বা শূকরের রক্ত ঢেলে দিয়ে ভালো করে নাড়তে হবে। এবার দেখুন, তরকারির রঙ কি কালো বা কালচে নীল হয়ে গেছে? এরপর গরম পানি পরিমাণ মতো ঢেলে দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন। পানি ফুটতে শুরু করলে সামান্য আতপ চালের গুঁড়া দিতে থাকুন, আর ভালোমত নাড়তে যতক্ষণনা ফুরা অর্থাৎ মিশ্রিত চাউলের গুঁড়ার পানি ঘন না হয়ে আসে।
  • না.খাম মি.চি অতি সাধারণ এবং সহজতম নাখাম মিচি রান্নার পদ্ধতি ও ঝামেলাহীন। বলা যায় আদা, তুলসিপাতার স্যুপ। এই পদ্ধতিতেও তেল, হলুদ, গরম মসলা জাতীয় বাড়তি খরচ নেই। প্রয়োজনমত হাঁড়িতে পানি (ঝোল) আর পরিমাণমত নাখাম, লবন, কাঁচা মরিচ, আদা, ফানেট (সাদা তুলসিপাতা) দিয়ে চড়িয়ে দিন। সেদ্ধ হয়ে গেলে আগুনের আঁচ কমিয়ে নিন এবং আস্তে আস্তে খারিচি বা খাবার সোডা দিয়ে নাড়তে থাকুন। সোডা দেওয়ার সময় খেয়াল রাখবেন যেন তরকারির পানি বা ঝোল দেনায় পরিণত হয়ে বাইরে পড়ে না যায়। ইচ্ছে হলে এই তরকারিতে কিছু কচি মুরগীর মাংস অথবা ছোট মাছ (বড় মাছ হলে ছোট ছোট টুকরো করে), অথবা মাছের শুটকী, নোনা ইলিশ দিতে পারেন। হাতের নাগালে ফানেত বা সাদা তুলসিপাতা না থাকলে কিছু হি.চিং (আদা)- এর পাতা দিয়ে নিন।
  • মেন্দাজাবা বা গা.লদা / মেসেংজাবা এটি একটি স্যুপ জাতীয় খাবার। ফল বা টকপাতা যাই হোক না কেন, রুচিবর্ধক হিসাবে গারোদের কাছে একটি অত্যন্ত উপাদেয়। এ পদ্ধতির রান্না খাবার পর আপনার শরীরটাকে চাঙ্গা মনে হবে। আবার প্রচণ্ড গরমে এবং ঠাণ্ডা জনিত অসুখে টকপাতার সাথে পরিমাণমত লবন, কাঁচামরিচ এবং পেঁয়াজ দিয়ে স্যুপ তৈরী করে খাওয়া যায়। টক ফলগুলো সাধারণত তৈল মসলার তরকারীতে সবজি হিসাবে খাওয়া হয়। আর টকপাতাগুলো মাছ, মাংস, শুঁটকীর সাথে ব্যবহার হয় মসলা হিসাবে। মোদ্দা কথা, টকফল এবং টকপাতার তরকারি অনেকভাবেই খাওয়া যায়। গারোরা কয়েক প্রকারের টকপাতা খেয়ে থাকে যেমন- মেন্দা বা গালদা, সেরেংখি, রাজাগুরু, আদুরাক, সামাদুরাক ইত্যাদি। আবার ফলের মধ্যে কাঁচা আমা, টকবড়ই, আমলকী, মিচেং ইত্যাদি। তেল তরকারি রান্না করতে চাইলে অন্যান্য সব্জির রান্নার মতো রেধে ফেলুন। আর স্যুপ স্টাইলে রান্না করতে চাইলে পরিমাণমত লবন, কাঁচামরিচ এবং পেঁয়াজ দিয়ে নিন। মোটেই খাবার সোডা দেওয়া যাবে না। টকপাতার ভর্তা খেতে চাইলে পাতাগুলো ভাত রান্না করার সময় কাঁচা মরিচ এবং পেয়াজসহ ভাতের উপর রেখে দিন। আর স্যুপ খেতে চাইলে লবন মরিচ কম দিয়ে সাথে কচি মুরগীর মাংস যুক্ত করুন।
  • সো. বা সো.খাংক্রতা সো.আ বা সো.খাংক্রতা আগুনে পোড়া বা ঝলসানো। মাছ বা মাংসের টুকরো কয়লার আগুনে পুড়ে খাওয়ার উপযোগী (নরম) করে পোড়া মাছ বা মাংস থেকে আগুনের পোড়া অংশ, ছাইগুলো পরিষ্কার করে নিতে হবে। মোটেই পোড়ানো মাংসগুলো পানি দিয়ে ধোয়ার চেষ্টা করবেন না, তাতে প্রকৃত স্বাদ থেকে নিশ্চিত আপনি বঞ্চিত হবেন। এরপর পেয়াজ, লবন এবং পরিমিত সরিষার তেল মেখে চটকিয়ে ভর্তা করে নিন। এ পদ্ধতির নামই সো.আ বা সো.খাংক্রতা। এভাবে মাছ, মাংস, শুঁটকী, চেপা শুঁটকী ইত্যাদি এবং বেগুন, আলু জাতীয় সবজি ভর্তা করে খাওয়া যায়।
  • থানিংজাবা বা থারু ভর্তা থানিং বা থারু মানে হচ্ছে মগজ। অর্থাৎ মাথার খুলীর মধ্যে যে নরম মাংসটিকে থারু বা থানিং বলা হয়। থারু ভর্তা পদ্ধতিতে হাঁড়িপাতিল পোড়ানো কিংবা ধোয়ামুছার প্রয়োজন নেই। রান্নার উপাদান নরম মাংস সো.আ বা সো.খাংক্রতা/ঝলসিয়ে নিয়ে মগজটি কলাপাতায় থেপবা বা হুথেবা (মুড়ে) করে সেটিকে আগুনের ছাইয়ের ভেতরে রেখে পাকাতে হয়। কাঁচা মরিচগুলোও আগুনে দিয়ে ছেকে নরম করে নিতে হবে। এরপর ঝলসানো মাংস, পাকানো মগজ আর পোড়ানো কাঁচা মরিচ, লবন, পেয়াজ গেলে সবগুলো একসাথে মাখামাখা ভর্তা করুন। এ রান্নায় ঝালের পরিমাণ কিছু বেশি দিতে দেয়া ভালো। গারোরা এ পদ্ধতির রান্নায় শুকড়ের কান, লেজ ইত্যাদি পুড়িয়ে একইভাবে মগজ এবং লবন মরিচ দিয়ে ভর্তা করে চু-এর সাথে এপাটাইজার বা খাঁজি খেতে পছন্দ করে। এ মগজ ভর্তা স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়।

এছাড়াও আরও অনেক গারো খাবারে স্বতন্ত্র রন্ধন পদ্ধতি রয়েছে। যা চোখে না দেখলে কিংবা খাবার চেখে না দেখলে বুঝার উপায় নেই। রন্ধন প্রণালীগুলো খুবই সাদামাটা। কিন্ত খাদ্যের স্বাদ এবং খাবার গুণগত মান অন্যান্য খাবারের তুলনায় বেশি বললে অত্যুক্তি হবে না। এক কথায় ডিজেস্ট্যিভ খাবার। অর্থাৎ এসব খাবারগুলো আরও বৈজ্ঞানিক উপায়ে মান নিয়ন্ত্রণ করে, নান্দানিক উপায়ে উপস্থাপন এবং পরিবেশন করা যেত তাহলে ভিন্নদেশি যেকোন খাবারকে টপকে যেতে পারতো, সমাদৃত হতো বলে আমার বিশ্বাস! এসব রান্না একবার খেলে, মুখে লেগে থাকা খাবার স্বাদ কখনো হারিয়ে যায় না। তথ্য (প্রকাশিতব্য গ্রন্থ): গারো সংস্কৃতির মাধুর্য 

লুই সাংমা, প্যারিস, ফ্রান্স

ওয়েভ ডেভেলপার, ব্লগার, আন্তর্জাতিক ফ্রিল্যান্সার এবং সাংস্কৃতিক কর্মী।